গাজীপুরে প্যাকেজিং কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে নিহত ২৪,আহত অর্ধশতাধিক

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.09.10
160910-BD-factory-1000.jpg হঠাৎ বিস্ফোরণে টঙ্গীর ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড নামের একটি প্যাকেজিং কারখানার পাঁচতলা ভবন ধসে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়। সেপ্টেম্বর ১০, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

ঈদুল আজহার মাত্র তিন দিন আগে গাজীপুরের টঙ্গীতে একটি প্যাকেজিং কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অন্তত ২৪ জন নিহত হয়েছেন। গাজীপুর পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

শনিবার ভোরে কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে বিস্ফোরণ, ভবন ধস ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় আহতের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক। এ ছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন বেশ কিছু শ্রমিক।

রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের পর এটাকে বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম কারখানা দুর্ঘটনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাঁদের মতে, এই প্রধান দুটি দুর্ঘটনার পরে পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ উন্নত হলেও নজর দেওয়া হয়নি অন্যান্য কারখানাগুলোতে। ফলে এসব কারখানাগুলোতে সুযোগে নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না কারখানা মালিকদের অনেকেই।

দুর্ঘটনার পরে ঘটনাস্থলে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা বেনারকে জানান, ভোর ৬টার দিকে হঠাৎ করেই বিকট শব্দে পাঁচতলা ভবনটি ধসে পড়ে। এর কয়েকমুহর্তের মধ্যেই দুর্ঘটনাস্থলে আগুন ধরে যায়। এসময় কারখানাটিতে শতাধিক শ্রমিক কাজ করছিলেন।

ট‌্যাম্পাকো ফয়েলস নামে ওই কারখানা প্যাকেজিং ও প্লাস্টিকের প্যাকেট  এবং  ফয়েল তৈরীর কাজ করে। এর মালিক বিএনপির সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেন লেবু। দুর্ঘটনার পর থেকে পুলিশ তাকে খুঁজে পাচ্ছে না।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর নিহত ও আহতদের ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়। সন্ধ্যা নাগাদ সব লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে জড়ো করা হয়।

নিহতদের কেউ অগ্নিদগ্ধ হয়ে, কেউবা কারখানার কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে মারা যান। অনেকে আবার হাসপাতালে নেওয়ার পর শেষ নিঃশ্বাস ছাড়েন। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পথচারিও রয়েছেন।

এদিকে প্রিয়জনদের খোঁজ না পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছেন পরিবারের সদস্য ও স্বজনরা। বিভিন্ন হাসপাতাল ও কারখানার সামনের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে তাদের কান্না আর আহাজারিতে।

ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের আগুন নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করছে। ছবি: নিউজরুম ফটো।

আটকে পড়া শ্রমিকের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি

দুর্ঘটনার প্রায় ১৫ ঘণ্টা পরও ভবনটিতে আটকে পড়া শ্রমিকদের সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করতে পারেনি কোনো পক্ষই। তবে আহত শ্রমিক, মালিক পক্ষ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য এবং হাসপাতালগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এই সংখ্যা অর্ধশতেরও বেশি।

কারখানাটির মালিক সিলেটের মকবুল হোসেন টেলিফোনে কয়েকজন সাংবাদিককে জানান, কারখানাটিতে রাতের শিফটে ৭৫ জন শ্রমিক কাজ করছিলেন।

তবে একজন আহত শ্রমিক মনোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “প্রায় ৪০০ শ্রমিক তিন শিফটে কাজ করতাম। রাতে প্রায় দেড়শ শ্রমিক কাজ করছিলেন। তারা বের হওয়ার আগে সকালে শিফট বদলির সময় আরও কিছু কর্মী কারখানায় ঢোকেন। সব মিলেয়ে প্রায় দেড়শ থেকে পৌনে দুইশ শ্রমিক দুর্ঘটনার সময় ভেতরে থাকতে পারেন।”

শ্রম সচিব মিকাইল শিপার বেনারকে বলেন, “লাশের সংখ্যা কত হতে পারে সেটি এখনই ধারণা করা যাচ্ছে না।”

তিনটি তদন্ত কমিটি

এ ঘটনায় তদন্তে পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে দুর্ঘটনার পর গাজীপুর জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস এবং কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এসব তদন্ত কমিটি গঠন করে।

ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. বদিউজ্জামানকে প্রধান করে গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

গাজীপুর প্রশাসক এসএম আলম বেনারকে জানান, “জেলা প্রশাসনের পাঁচ সদস্যের কমিটি আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে।”

এছাড়া কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বয়লার বিস্ফোরণ হয়নি

দুর্ঘটনার শুরু থেকেই বলা হচ্ছিল, বয়লার বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধস হয়েছে। তবে, শনিবার বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে শিল্প মন্ত্রণালয়ের কারখানা পরিদর্শক প্রকৌশলী শরাফত আলী বেনারকে বলেন, “কারখানাটির দুটি বয়লারই অক্ষত রয়েছে। আমরা বাইরে থেকে তা দেখেছি। আমাদের ধারণা, গ্যাস সিলিন্ডারের স্টোররুম থেকে বিস্ফোরণটি হতে পারে। কারখানাটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।”

এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের প্রধান বয়লার পরিদর্শক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বেনারকে বলেন, “বয়লার দুটি পরীক্ষা করে গত জুন মাসে নবায়ন করা হয়। আগামী জুন পর্যন্ত এদের মেয়াদ রয়েছে।”

দুই পায়ে আঘাতপ্রাপ্ত শ্রমিক মনোয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “সকাল ৬টার আগে কারখানায় ঢুকেই সোঁ সোঁ শব্দ শুনতে পাই। এসময় একজন সহকর্মী জানান, গ্যাস পাইপে লিক হয়েছে। তবে জানানোর পরও কেউ তা ঠিক করতে আসেনি। এর কিছুক্ষণ পরেই ভয়ংকর শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এসময় আমি পড়ে যাই।”

এদিকে দিনভর চেষ্টা করেও আগুন নেভাতে পারেনি ফায়ার সার্ভিসের ২৯টি ইউনিট। সন্ধ্যার দিকে আবারও ভবনটিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে।

এ সময় ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা মো. বদিউজ্জামান বেনারকে বলেন, “কোনোভাবেই ভবনের ভেতরে পানি দেওয়া যাচ্ছে না। এখন আমাদের আর কিছু করার নেই। তবে আমরা রাতভর আগুন নেভানোর চেষ্টা করে যাব।”

নিহত শ্রমিক পরিবারকে ২ লাখ টাকা

এ দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেক শ্রমিকের পরিবারকে দুই লাখ ও আহত প্রত্যেককে এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনের সময় বেনারকে একথা জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু।

এছাড়া গাজীপুর জেলা প্রশাসন নিহত প্রত‌্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা ও আহত প্রত‌্যেককে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহনের কথা বলা হয়েছে। কারখানার মালিক মকবুল হোসেন পলাতক থাকলেও হতাহত কর্মীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

তবে ওই কারখানায় কোন ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেলে মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।

এর আগে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাজধানীর অদূরে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। ওই দুর্ঘটনায় ভবনটির বিভিন্ন তলার গার্মেন্টেসে কর্মরত প্রায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত হন দুই হাজারেরও বেশি শ্রমিক। এটি বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত।

এছাড়া ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ায় তাজরিন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১২ শ্রমিকের মৃত্যু হয়। দেশে বিদেশে বহুল আলোচিত ওই দুটি দুর্ঘটনার বিচার কাজ চলছে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।