ট্যাম্পাকোর মালিক পলাতক, ক্ষতিগ্রস্ত ও বেকার শ্রমিকদের দুর্বিষহ জীবন

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.10.28
161028-factory-fire1000.jpg ট্যাম্পাকো দুর্ঘটনার পর নিখোঁজ স্বামীর সন্ধানে স্ত্রীর আহাজারি। সেপ্টেম্বর ১১, ২০১৬।
স্টার মেইল

টঙ্গীর শিল্পকারখানা ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর দেড় মাসেরও বেশি সময় পার হয়েছে। কিন্তু এখনো কারখানাটির মালিককে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। হঠাৎ চাকরি হারিয়ে পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কারখানার শ্রমিক-কর্মচারী-কর্মকর্তারা।

নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবার এবং বেকার কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুর্ঘটনার পর ট্যাম্পাকো কর্তৃপক্ষ তাদের কোনো ধরনের আর্থিক সহায়তা করেনি। এমনকি কোনো খোঁজও নেয়নি। শুধুমাত্র জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে নিহতদের পরিবার ২০ হাজার টাকা এবং আহতদের পরিবার ১০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছেন।

খাদ্য ও কসমেটিক পণ্য মুড়ে রাখার অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্রস্তুতকারী ট্যাম্পাকো কারখানা গত ১০ সেপ্টেম্বর সকালে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর আগুনে পুড়ে যায়। এ ঘটনায় ৪২ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে কারখানার কর্মী ৩৯ জন। আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন।

দুর্ঘটনার পর গ্রেপ্তার এড়াতে গা ঢাকা দিয়েছেন কারখানার মালিকেরা। তবে আড়ালে থেকেও কারখানার ধ্বংসস্তূপ অপসারণের কাজ করাচ্ছেন তারা। ধ্বংসস্তূপ অপসারণে এরই মধ্যে তারা ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছেন।

দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে ফায়ার সার্ভিস, গাজীপুর জেলা প্রশাসন এবং শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করে। এর মধ্যে শুধু শিল্প মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কিন্তু ঘটনার কারণ সম্পর্কে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

মালিকের বিরুদ্ধে মামলা

টঙ্গী মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) অজয় কুমার চক্রবর্তী বাদী হয়ে ঘটনার ছয় দিন পর মামলা করেন। এতে কারখানার মালিক মকবুল হোসেন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহম্মেদসহ কারখানার মোট ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ কয়েকটি অভিযোগ আনা হয়।

দুর্ঘটনার পর ট্যাম্পাকো কারখানা ছবিঃ স্টার মেইল।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কারখানা ভবনটি চার বছর আগে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। তাই এটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল এবং কারখানার বয়লার বা গ্যাসলাইন ত্রুটিপূর্ণ ছিল। তা জেনেও কারখানার মালিক এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

এজাহারে আরও বলা হয়েছে, উপস্থিত শ্রমিক ও সাধারণ লোকজন জানিয়েছেন, কারখানার গ্যাসের পাইপলাইন কয়েক দিন ধরে ফুটো (লিক) ছিল, যা মালিক এবং কর্তৃপক্ষকে বলার পরও মেরামতের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

মকবুল হোসেন সিলেট-৬ আসনের সাবেক সাংসদ। মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা টঙ্গী থানার উপপরিদর্শক সুব্রত ভক্ত বেনারকে বলেন, “মামলায় আসামিদের স্থায়ী ঠিকানা নেই। আগুনে কারখানার সব কাগজপত্র পুড়ে গেছে।”

তিনি জানান, আসামিদের ঠিকানা এখনো জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ঠিকানা জোগাড়ের চেষ্টা চলছে।

বিপাকে কারখানার কর্মীরা

কারখানায় সহকারী হিসেবে কাজ করতেন দিলীপ চন্দ্র দাস। তিনজনের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী তিনিই। দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি বেকার। এখন পরিবার কীভাবে চালাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপত্তার দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন অক্টোবর ২৮, ২০১৬ নিউজরুম ফটো।

দীলিপ বেনারকে বলেন, “সহকারীর কাজ করায় আমার বেতন বেশি ছিল না। পরিবার টেনেটুনে চলত। দুর্ঘটনার পর বেকার হয়ে এখন দিশেহারা।”

দিলীপ আরও বলেন, আহত হওয়ার পর জেলা প্রশাসন থেকে দশ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু কারখানার মালিকপক্ষ তাদের খোঁজ নেয়নি।

কারখানার আরেক শ্রমিক সুজন আহমদ বেনরাকে বলেন, তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। ট্যাম্পাকো থেকে যে টাকা পেতেন তা দিয়েই পরিবার ঠিকমতো চলতো না। ছেলে মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে রেখে ঢাকায় তিনি একাই থাকতেন।

“দুর্ঘটনার পর এখন পর্যন্ত কোনো কাজ পাইনি। ঘটনার পর থেকে ঢাকায় আছি। বিভিন্ন জায়গায় চাকরির জন্য যোগাযোগ করছি,” জানান সুজন।

স্বামীর লাশ খুঁজছেন নার্গিস

ঘটনার দিন থেকে নিখোঁজ রয়েছেন কারখানার অপারেটর রফিকুল ইসলাম। তার স্ত্রী নার্গিস আক্তার বলেন, স্বামী ও তিন সন্তানকে নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীর মরকুন তিস্তার গেট এলাকায় ভাড়া থাকতেন। নার্গিস বেনারকে জানান, তার স্বামীর লাশ এখনো পর্যন্ত তিনি পাননি। জেলা প্রশাসন ও থানায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি।

শুধু নার্গিসই নন আরও দশটি পরিবার তাদের স্বজনদের লাশ এখনো পাননি।

ট্যাম্পাকোর বর্তমান অবস্থা

দুর্ঘটনার পর সেনাবাহিনীর একটি দল টাম্পাকোর ধ্বংসস্তূপের উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। গত ১০ অক্টোবর কারখানায় আর কোনো লাশ না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় ধ্বংসস্তূপ অপসারণ ও উদ্ধার অভিযান শেষ করে তারা।

এরপর ধ্বংসস্তূপ অপসারণের কাজ শুরু করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। ধ্বংসস্তূপ অপসারণের কাজ করছে ‘মা ট্রেডার্স’ নামে স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান।

প্রতিষ্ঠানটির মালিক রফিকুল ইসলাম বেনরাকে বলেন, ধ্বংসস্তূপ সরাতে কয়েক মাস সময় লেগে যাবে।

কারখানার এক বেকার কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বেনারকে বলেন, “মোট ৩০৩ জন শ্রমিক ও কর্মকর্তা কারখানাটিতে কাজ করতেন। ঘটনায় মারা গেছেন ৩৯ জন। বাকি ২৬৪ জনের প্রায় সবাই এখন বেকার।”

ক্ষতিগ্রস্তরা যেটুকু পেলেন

দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসন নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ২০ হাজার ও আহত ব্যক্তিদের ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছে।

গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার প্রধান সহকারী এস এম সোলায়মান বেনারকে বলেন, “দুর্ঘটনায় নিহত মোট ৪২ জনের মধ্যে ইতিমধ্যে শনাক্ত হওয়া ৩১ জনের পরিবারকে এবং আহত ৭ জনকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। বাকি আহত ৭ জনের সহায়তা প্রক্রিয়াধীন।”

শ্রম মন্ত্রণালয়ের সহায়তার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব মিকাইল শিপার বেনারকে বলেন, “নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে ২ লাখ এবং আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা খরচ বাবদ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হবে। আমরা এখন পর্যন্ত মাত্র ১৮ জনের তালিকা পেয়েছি। তালিকা পূর্ণাঙ্গ করার কাজ চলছে।”

তদন্তের হালচাল

ঘটনার দিনই ফায়ার সার্ভিস তাদের উপপরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. বদিউজ্জামানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তাদের ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল।

জানতে চাইলে বদিউজ্জামান বেনারকে বলেন, “ট্যাম্পাকোতে ভবন ধসে পড়েছে, রাসায়নিক দ্রব্যের বিস্ফোরণ হয়েছে, গ্যাসের সংযোগও ছিল। এ ধরনের ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনের জন্য যে ধরনের প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রয়োজন, তা তাদের নেই।”

“তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি ও বিভিন্ন সংস্থার মতামতের ভিত্তিতে আমরা প্রতিবেদন তৈরি করেছি। আগামী সপ্তাহেই প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হবে,” জানান বদিউজ্জামান।

 

 

 

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।