দেশীয় জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা হয় বিদেশ থেকেও

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.09.20
20160920-BD-RAB1000a.jpg হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর ভেতরে আটক দেশি-বিদেশি জিম্মিদের উদ্ধারে র‍্যাবের প্রস্তুতি। জুলাই ১, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার জের ধরে ঢাকার কল্যাণপুর, রূপনগর, আজিমপুর ও নারায়ণগঞ্জে পুলিশের অভিযানে ১৬ জন নিহত হওয়ার পর জঙ্গিগোষ্ঠী অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে বলে মনে করছে পুলিশ। এখন জঙ্গিদের অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিচ্ছে কারা তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের অস্তিত্ব নেই। এখানে যারা বিভিন্ন ঘটনা ঘটাচ্ছে, তারা এ দেশেরই বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। কিন্তু দেশের বাইরে এই জঙ্গিগোষ্ঠীর আর্থিক যোগসূত্র থাকার তথ্য পাচ্ছে পুলিশ।

দেশের বাইরে প্রথম জঙ্গিদের অর্থ লেনদেনের তথ্য পাওয়া যায় সিঙ্গাপুরে। জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থ সংগ্রহ ও সহায়তার বিষয়টি স্বীকার করার পর গত জুলাই ও আগস্টে সিঙ্গাপুরের আদালত দুই দফায় বাংলাদেশের ছয় শ্রমিককে কারাদণ্ড দেয়।

বিদেশের মাটিতে জঙ্গিদের এই তৎপরতা ও অর্থ সংগ্রহের সেই খবরে নড়েচড়ে বসে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়ে সতর্ক করা হয়। কিন্তু গুলশান হামলায় জঙ্গিদের অর্থের সরবরাহ ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসেনি বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।

গত সোমবার গুলশান হামলা মামলার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে গিয়ে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, হামলায় ব্যবহার হওয়া প্রায় ১৪ লাখ টাকা এসেছে হুন্ডির মাধ্যমে।

সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের কথা বললেও দেশটির নাম প্রকাশ করেননি। তবে পুলিশের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বেনারকে নিশ্চিত করেছে যে, দেশটি হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)।

মনিরুল আরও জানান, এ টাকা জঙ্গিরা অস্ত্র সংগ্রহ ও বাসা ভাড়ার কাজে ব্যবহার করেছে। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, “হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের গায়ে প্রস্তুতকারী দেশের নাম না থাকায়, ওগুলো কোন দেশের তা বলা যাচ্ছে না। তবে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এসব অস্ত্র ভারত হয়েই বাংলাদেশে এসেছে।”

পুলিশের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গুলশান হামলায় অর্থের জোগান কে বা কারা দিয়েছে, অস্ত্র এসেছে কোথা থেকে—তদন্তকারীদের মনযোগ এখন সেদিকেই। দেশে বেড়ে ওঠা জঙ্গিগোষ্ঠী গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার সঙ্গে জড়িত বলা হলেও এসব হামলার অর্থ ও অস্ত্র দেশের বাইরে থেকে আসার বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।

“আমরা গুলশান হামলার অর্থদাতাকে চিহ্নিত করেছি। এ দেশে কার নামে অর্থ এসেছে তাও জানা গেছে। অভিযুক্তদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে,” বেনারকে জানান পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন।

এদিকে পুলিশের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বেনারকে বলছে, নিউ জেএমবির পেছনে সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জাহিদুল ইসলাম বড় অঙ্কের টাকা খরচ করেন। এ ছাড়া নিহত সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা তানভির কাদেরি তার উত্তরার ফ্ল্যাট বিক্রির টাকাও জেএমবিকে দিয়েছিলেন বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ।

ওই সূত্রটি আরও জানিয়েছে, নতুন এই জঙ্গি সংগঠনের পরিচালনা ব্যয় মেটাতে দেশি কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি টাকা দিয়েছে। এমন দুটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।

“দেশে অভ্যন্তরীণভাবে জঙ্গি-মৌলবাদীদের অর্থনৈতিক শক্ত ভিত্তি খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ডের ওপর তৃতীয় পক্ষীয় অডিট করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণভাবে জঙ্গি-মৌলবাদীদের অর্থনৈতিক শক্ত ভিত্তি খতিয়ে দেখতে হবে,” বেনারকে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. বারকাত আরও বলেন, “মৌলবাদীরা ব্যাংক-বীমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো নয়টি বড় খাতে বিনিয়োগ করেছে, সেগুলো তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে অডিট করা হোক।”

গত ২৯ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তথ্য দেওয়া হয়, ২০১৫ সালে মৌলবাদীরা ২ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা নিট মুনাফা করেছে এবং গত ৩৫ বছরে তাদের পুঞ্জীভূত নিট মুনাফা ২ লাখ কোটি টাকার ওপরে।

সম্মেলনে ‘বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী জঙ্গিত্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি: এক কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদে যখন বহিস্থ কারণ অভ্যন্তরীণ কারণকে ছাপিয়ে যায়’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত।

প্রবন্ধে তিনি বলেন, জঙ্গিদের অর্থায়নের উৎস সম্পর্কে সরকারের যা কিছু জানা আছে, তা অতি দ্রুত গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার করা উচিত। জঙ্গি অর্থায়নের উৎসমুখ বন্ধ করতে মৌলবাদীদের ২৩১টি ট্রাস্ট ও ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ ৫ বছরের তৃতীয় পক্ষীয় অডিট করার প্রস্তাব দেন ড. বারকাত।

গত ১ জুলাই জঙ্গিরা গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলা চালিয়ে ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে হত্যা করে। তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে নিহত হন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা। ইরাক-সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস ওই হামলা ও হত্যাযজ্ঞের দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিলেও বাংলাদেশ পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় নব্য জেএমবি জড়িত।

পরে উদ্ধার অভিযানে হামলায় জড়িত পাঁচ জঙ্গি এবং ওই রেস্তোরাঁর এক পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হয়। সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হওয়া রেস্তোরাঁর আরেক কর্মী জাকির হোসেন ওরফে শাওন পরে হাসপাতালে মারা যায়। জাকিরের পরিবারের অভিযোগ, ১ জুলাই রাতে আটকের পর নির্যাতনের কারণে জাকির মারা গেছে।

জেএমবির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শক্তি খর্ব করা হয়েছে উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “নব্য জেএমবির কমান্ডিং পর্যায়ের নেতা, সমন্বয়কারী এবং প্রশিক্ষক নিহত হয়েছে। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছে, কেউবা পুলিশের নজরদারিতে আছে। এখন তাদের অর্থের উৎস খোঁজা হচ্ছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।