হলি আর্টিজানে হামলাকারী ছয় জঙ্গির লাশ ‘অজ্ঞাত পুরুষ’ হিসেবে দাফন
2016.09.22

গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর শেফ সাইফুল চৌকিদারের লাশ গতকাল বৃহস্পতিবার আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে ‘অজ্ঞাত পুরুষ’ হিসেবে দাফন করা হয়েছে।
নিহত তিন জঙ্গির স্বজনেরা দাবি করেছেন, লাশ দাফনের আগে তাঁদের কিছুই জানানো হয়নি। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, মরদেহ নিতে কেউ যোগাযোগ করেনি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতাল সূত্র জানায়, পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানে নিহত কমপক্ষে ১৪ জঙ্গির মৃতদেহ এখন পর্যন্ত হাসপাতালের মর্গে রয়েছে। লাশগুলো নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ কি করবে জানতে চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে।
গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পরদিন অর্থাৎ ২ জুলাই থেকে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গি রোহান ইমতিয়াজ, নিবরাস ইসলাম, মীর সামেহ মোবাশ্বের, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল এবং হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর শেফ সাইফুল চৌকিদারের মৃতদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) মর্গে ছিল।
“বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে লাশগুলো হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ূন কবীরের কাছে হস্তান্তর করা হয়,” বেনারকে জানান আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লে. কর্নেল রাশিদুল হাসান।
তিনি জানান, এ সময় পুলিশের পক্ষ থেকে তিনজন এবং আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের নয়জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
নিহত জঙ্গিদের স্বজনেরা যা বলেন
তবে নিহত তিন জঙ্গির স্বজনেরা দাবি করেছেন, লাশ দাফনের আগে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। যদিও পুলিশের তত্ত্বাবধানে তাঁদের অপরাধ তদন্ত বিভাগে নিয়ে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। বগুড়ার বাকি দুই জঙ্গির অভিভাবকের ডিএনএ সংগ্রহ করেও ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল।
নিবরাস ইসলামের বাবা নজরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “গত ২০ জুলাই আমরা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগে গিয়েছিলাম। ওখানে রোহান, মোবাশ্বের ও সাইফুল চৌকিদারের অভিভাবকেরাও ছিলেন।”
তিনি জানান, “কথাবার্তা শেষে আমাদের সিআইডি কার্যালয়ে নেওয়া হয়। ওখানেই নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা ছিল। কিন্তু কেউ আর যোগাযোগ করেনি।”
গত ২৩ আগস্ট পুলিশ সংবাদমাধ্যমকে জানায়, অভিভাবকত্ব নির্ধারণের জন্য ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নমুনা মিলেও গেছে। কেউ চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগে যোগাযোগ করতে পারেন।
গতকাল কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার মহিবুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “লাশ নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি। সে কারণেই লাশগুলো আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে দেওয়া হয়েছে।”
আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম নামে এই বেসরকারি সংস্থাটি বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দায়িত্ব পালন করে থাকে।
এর আগে পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক জানিয়েছিলেন, জঙ্গিদের কার্যক্রমে তাঁদের অভিভাবকেরা লজ্জিত। সে কারণে তাঁরা লাশ নিতে আসছেন না।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “জঙ্গিদের ধারণা ছিল তারা খুবই জনপ্রিয়। হলি আর্টিজানে নিহত জঙ্গিদের লাশ পরিবার গ্রহণ না করায় জঙ্গিদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। তারা বুঝতে পারে যে তারা আসলে অত্যন্ত অজনপ্রিয়।”
নিহত অপর এক জঙ্গির স্বজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে লাশ চাননি। সন্তান জঙ্গি হওয়ায় এবং ন্যক্কারজনক হামলায় জড়িত হওয়ায় তাঁরা লাশ চাইতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন বলে জানান তিনি। তবে তিনি আশা করছিলেন, পুলিশই তাঁদের সঙ্গে কথা বলবে।
তবে,আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে লাশ হস্তান্তরের খবর পেয়েই ঢাকার তিন জঙ্গির স্বজনেরা জুরাইন কবরস্থানে যান।
ঢাকা মেডিকেলের মর্গে ঠাঁই নেই
পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানে নিহত কমপক্ষে ১৪ জঙ্গির মৃতদেহ এখন পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে পড়ে আছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ইসমাইল খান বেনারকে বলেন, “এগুলো আমরা কি করব তা পুলিশের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে।”
“লাশের রক্ষক পুলিশ। মেডিকেল কলেজের দায়িত্ব শুধু ময়নাতদন্ত করা এবং পুলিশকে লাশ বুঝিয়ে দেওয়া। বেশ কিছু লাশ মাসাধিককাল ধরে মর্গে রয়েছে,” জানান অধ্যক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজে মৃতদেহ রাখার জন্য ২০টি চেম্বার আছে। এর আটটিই নষ্ট। আটটিতে লাশ হিমায়িত করা যাচ্ছে না। ফলে ১২টি চেম্বারে ১৪টি মরদেহ রাখা হয়েছে।
ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বেনারকে বলেন, “জঙ্গিদের লাশে সব কটি চেম্বার পূর্ণ। নতুন কোনো লাশ আমরা রাখতে পারছি না। সে কারণেই আমরা অধ্যক্ষকে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছি”।
উল্লেখ্য, গত ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হত্যাযজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। ১২ ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর জিম্মি সংকটের রক্তাক্ত অবসান ঘটে পরদিন সকাল সাড়ে আটটার দিকে সেনা নেতৃত্বাধীন সমন্বিত অভিযানে। অভিযান শেষে ঘটনাস্থল থেকে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। অভিযানে নিহত হয় পাঁচ জঙ্গি ও ওই রেস্তোরাঁর একজন শেফসহ মোট ছয়জন।
এর আগে ১ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রথম দফা অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা, আহত হন অন্তত ৪০ জন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে আটক হলি আর্টিজানের এক কর্মচারী।