কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ছয়মাসে নিহত ৬২,মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ
2016.06.30
মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে ‘ক্রসফায়ারে’ ৬২ জন মারা গেছেন, যাঁদের মধ্যে ৩৭ জনের মৃত্যুর সঙ্গে পুলিশ জড়িত। অবশ্য আরেকটি মানবাধিকার সংগঠন ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন’ বলছে, পুলিশ ও র্যাবের ক্রসফায়ারে এই ছয় মাসে ৬৫ জন মারা গেছেন।
২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর ওই বাহিনী মূলত ক্রসফায়ারে জড়িত ছিল। কিন্তু এখন এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় পুলিশের সম্পৃক্ততা বেশি বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রকাশ করে। দেশের প্রধান জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর এবং সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায় থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে এসব প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে বা ক্রসফায়ারে নিহতের ঘটনাগুলো নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার। পুলিশের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় বন্দুকযুদ্ধে ‘জঙ্গি’ গোলাম ফাইজুল্লাহ ফাহিমের মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে নানা মহল থেকে। আবার পুরস্কার ঘোষিত ছয় জঙ্গির একজনকে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার ঘটনা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে।
বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন কয়েকদিন আগেই সংসদে দাঁড়িয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধের সমালোচনা করেন।
“এখন প্রায় প্রতিদিনই দেখছি ক্রসফায়ারে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী নিহত হচ্ছে। কিন্তু ক্রসফায়ার এই সমস্যার সমাধান নয়। বরং এর মধ্য দিয়ে আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা-ব্যর্থতা দেখছি,” বেনারকে জানান বিমানমন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন
সংস্থাটির হিসেবে, চলতি বছরের ছয় মাসে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারে ৬২ জন নিহত হয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ধরে নেওয়ার পরে খোঁজ মিলছে না আরও ৩৮ জনের।
এসময়ের মধ্যে ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাতে প্রাণ গেছে ১৪২ জনের, আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৮৫ জন।এছাড়াও চলতি বছর হত্যার শিকার হয়েছে ২৩৫টি শিশু।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘ক্রসফায়ারে’ নিহতের মধ্যে ৩০ জন পুলিশের গুলিতে, র্যাবের গুলিতে ২৪ জন, ডিবির গুলিতে সাতজন ও বিজিবির গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া, গ্রেপ্তারের আগে ও পরে পুলিশের শারীরিক নির্যাতনে পাঁচজন এবং গুলিতে পাঁচজন নিহত হয়েছেন। পুলিশের হেফাজতে থেকে ‘অসুস্থ’ হয়ে মারা গেছেন চারজন ও একজনের রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর ডিবির নির্যাতনে একজন ও বিজিবির গুলিতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
অন্যদিকে, সাদা পোষাকে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৫০ জনকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে এই ৫০ জনের মধ্যে ছয়জনের লাশ পাওয়া গেছে, দুজন ফেরত এসেছেন ও পরবর্তীতে চারজনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। বাকি ৩৮ জনের খোঁজ নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে ৮১১টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব সহিংসতায় ১৫৪ জন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন ১০ হাজার ২৯০ জন। এর মধ্যে ছয় ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রাণ হারিয়েছেন ১৪২ জন ও আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৮৫ জন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৬৯৩টি।
প্রতিবেদনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে পঞ্চগড়, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঝিনাইদহ ও পাবনায় হিন্দু ধর্মানুসারী অধ্যক্ষ, সাধু, দর্জি, পুরোহিত ও সেবায়েতসহ পাঁচজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
শিশু নির্যাতন ও হত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে ৫৯১ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ২৩৫ জন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে ও ১৫ জন শিশু নির্যাতনের পর আত্মহত্যা করেছে।
ছয় মাসে সীমান্তে বিএসএফ এর গুলিতে মারা গেছেন ১২ জন, আহত হয়েছেন ১৭ জন ও অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৮ জন। অপহরণের পর বিজিবির মধ্যস্থতায় ১৭ জন ফেরত এসেছেন। কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৪২ জন। এর মধ্যে কয়েদি ১৪জন ও হাজতি ২৮ জন। এ ছাড়া বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে গণপিটুনিতে প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ জন।
এসময়ে অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ১৭ জন নারী, এর মধ্যে একজন মারা গেছেন। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে তিনজন নারী আত্মহত্যা করেছেন।
পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০৯ জন নারী। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে ১৪০জনকে হত্যা করা হয়েছে, আত্মহত্যা করেছেন আরও ২৭ জন।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, গত ছয় মাসে ৭৪ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক নূর খান বেনারকে বলেন, “দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বোঝার জন্য সংখ্যাগত এই প্রতিবেদন যথেষ্ট। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা।” তাঁর মতে, কাউকে বিনা বিচারে মেরে ফেলে দেশ থেকে সন্ত্রাস দূর হবে না, মানবাধিকার রক্ষা হবে না।
মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ‘নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের সংখ্যা’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ছয়মাসে ৪২০ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের পরে হত্যা করা হয়েছে ১৫ জনকে। ২২ জন নারীকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০৫ জন নারীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে।
গত ছয় মাসে ১৪টি পত্রিকা থেকে তথ্য নিয়ে এ সংখ্যাগত প্রতিবেদনটি করার কথা জানিয়েছে মহিলা পরিষদ।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন
বেসরকারি সংস্থা মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে জুন ২০১৬ পর্যন্ত ছয় মাসে ক্রসফায়ার ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং বিভিন্ন কারণে হত্যাকাণ্ডে মোট নিহতের সংখ্যা ১ হাজার ১৮৫ জন। কমিশন হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। ছয় মাসে গড়ে প্রতিদিন হত্যাকাণ্ড ঘটে প্রায় ৬ দশমিক ৫১ জন।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও পৌরসভার শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
“এ ধরনের হত্যাকাণ্ড অবশ্যই আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগের কর্মকর্তাদের অবশ্যই অধিক দায়িত্ববান হতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গতিশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড কমিয়ে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব,” বেনারকে জানান বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের গবেষণা শাখার সহকারি পরিচালক জাহানারা আক্তার।