মানবপাচারের ঘটনায় অপরাধ প্রমাণ হচ্ছে না,পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীচক্র

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.05.13
Human-Trafficking620.jpg কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূলে এভাবেই মানবপাচারের শিকার হন নিরীহ মানুষ। মে ২০১৫।
বেনার নিউজ

বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা মানবপাচারের ঘটনায় বাংলাদেশে চার শতাধিক মামলা হলেও অভিযুক্তদের সাজা হচ্ছে না। সঠিকভাবে মামলা না হওয়ায় আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা যাচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন।

তবে জেল-জরিমানা, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কঠোরতায় বাংলাদেশ থেকে কমে এসেছে সমুদ্রপথে মানবপাচারের ঘটনা। গত এক বছরে যা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি শিথিল হলে এই অপরাধ আবারও বেড়ে যেতে পারে। সমুদ্রপথে অবৈধ অভিবাসন কমলেও বিকল্প পথে তা অব্যাহত থাকার অভিযোগও রয়েছে।

গত বছরের মে মাসে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলে অসংখ্য গণকবর আবিষ্কৃত হয়। মিয়ানমার, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সমুদ্র পথে পাচারের শিকার হয়ে বন্দীশিবিরে কিংবা যাত্রাপথে প্রাণ হারানো মানুষদের এসব কবর সেসময়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

মানবপাচার রোধে সোচ্চার ও কঠোর হয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকার। ওই ঘটনার পর বাংলাদেশও মানবপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। অসংখ্যা মামলা আর গ্রেপ্তারের ফলে কমে আসে উপকূলীয় অঞ্চল কক্সবাজার থেকে সমুদ্রপথে মানবপাচার। বেশ কয়েকজন মানবপাচারকারী বন্দুকযুদ্ধেও নিহত হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, মানবপাচারের ঘটনায় গত কয়েক বছরে সারা দেশে ৪২৯টি মামলা হয়। এখন পর্যন্ত ১৭টি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। কো​নও মামলায় আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করার মত যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি।এর ফলে বিচারহীনতার চক্রেই আটকে থাকছে মানবাপাচারের মত ভয়াবহ অপরাধ।

জানা যায়, সারা দেশে করা মামলায় মোট তিন হাজার ২৭০ জনকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে আটক হয় এক হাজার ৬৪৯ জন। তাদের প্রায় সবাই এখন জামিনে মুক্ত।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে করা মামলা যথাযথ আইনে না হওয়ায় তারা শাস্তির হাত থেকে রেহাই পেয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অনেক অপরাধী সহজে জামিনও পেয়ে যাচ্ছে। ফলে যেকোনো সময় আবারও সমুদ্র পথে মানবপাচার বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

বিকল্প পথে পাচার বেড়েছে

সমুদ্রপথে মানব পাচার কমলেও বিকল্প পথে অবৈধ অভিবাসন বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এক ধরনের দালাল চক্র আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের জিম্মি করে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছে। এর প্রমাণ মেলে লিবিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের ফেসবুক পেজে দেওয়া এক বার্তায়।

গত ৫ মে প্রবাসীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেওয়া ওই পোস্টে বলা হয়, সম্প্রতি সুদান হয়ে মানব পাচারকারীদের সহায়তায় বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে লিবিয়ায় প্রবেশ করছেন। দেশটিতে প্রবেশের পর আজদাবিয়ায় সংঘবদ্ধ বাংলাদেশি দালাল চক্রের হাতে জিম্মি হচ্ছেন তাঁরা। এরপর পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা দালালদের দিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারিরা বাধ্য হচ্ছেন। অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকারও হচ্ছেন কেউ কেউ।

ওই পোস্টে ১৯ জন দালালের তালিকা এবং এদের একজনের ছবি প্রকাশ করে মানবপাচারকারীদের তথ্য দূতাবাসকে জানিয়ে সহায়তা করার অনুরোধ করা হয়।

এ প্রসঙ্গে রিফ্যুজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসোর্স ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপার্সন ড. তাসনিম সিদ্দিকী বেনারকে বলেন, “গত বছর আন্তর্জাতিক বিশ্বে নজর কাড়ার ফলে এখন অবশ্যই সমুদ্রপথে মানবপাচার কমে এসেছে। তবে এটা ব্যাপক কোনো পরিবর্তন নয়।”

“আন্তর্জাতিক সভা–সেমিনার বলতে গেলে কোনো সমাধানই আনেনি, শুধু সাময়িকভাবে পরিস্থিতি ঠান্ডা করেছে। এখন সমুদ্র পথে অবৈধ অভিবাসন কমলেও ভিন্ন পথে হচ্ছে। সুদান, লিবিয়া, ইরাক প্রভৃতি দেশে অবৈধ পথে অভিবাসন বাড়ছে। এসব পথ বন্ধেও সোচ্চার হতে হবে,” জানান ড. তাসনীম।

যথাযথ আইনে মামলা না হওয়ার অভিযোগ

সমুদ্র পথে মানবপাচারের মামলাগুলো সঠিক আইনে না হওয়ায় এসব মামলার দুর্বলতা থেকে গেছে। আর এ সুযোগে মানবপাচারের অভিযোগ থেকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে মূল হোতারা।

এ প্রসঙ্গে অভিবাসন বিশেষজ্ঞ তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, “সেই সময়ে মানবপাচারের মতো ঘৃণ্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত কারো বিরুদ্ধে যথাযথ আইনে মামলা হয়নি। ফলে দোষীরা কোনোরকম শাস্তি না পেয়েই পার পেয়ে যাচ্ছে। এ থেকে এ ধরনের অপরাধ আবারও করার অনুপ্রেরণা পাচ্ছে তারা।”

এসব মানবপাচারকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় বিচারের বাইরে থেকে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

দারিদ্রতাই কারণ নয়

বলা হচ্ছিল, দারিদ্রতার কারণেই মৃত্য ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ পথে অভিবাসনকে বেছে নেয় বাংলাদেশিরা। তবে অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। “অবৈধ অভিবাসনের কারণ হিসেবে আমাদের দেশের দারিদ্রকে বেশি দায়ী করা হয়। কিন্তু দারিদ্রের চেয়ে বেশি দায়ী পাচারকারী দালাল চক্র। বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত এই চক্র মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে নিয়ে যায়। এরপর মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ আদায় করে,” বেনারকে বলেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও রামরুর নির্বাহী পরিচালক ড. সি আর আবরার।

সোচ্চার সরকার

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের ফলেই সাগর পথের মানবপাচার প্রায় শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এ প্রসঙ্গে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আলী হোসেন বেনারকে বলেন, “মানব পাচার সংক্রান্ত মামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অনেকে বন্দুক যুদ্ধে মারা গেছে। কিছু লোক এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে। তাদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য খোঁজা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, যেসব অপরাধী জামিনে বেরিয়ে গেছে, তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। আর এসব পদক্ষেপে এখন দেশে মানবপাচার শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।”

এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “মানবপাচারের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কারণে এখন সাগরপথে মানবপাচার বন্ধ আছে। এ বিষয়ে বিচারাধীন মামলাগুলো নিষ্পত্তির মাধ্যমে দোষীদের অবশ্যই শাস্তির মুখোমুখি করা হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।