গরু চোরাচালান সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যার মূল কারণ
2016.10.07

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যার অন্তত ৯৫ ভাগই ঘটছে গরু চোরাচালানের কারণে। এটা বন্ধ করা গেলে সীমান্ত হত্যার পাশাপাশি নানা ধরনের অপরাধ কমে যাবে।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ গতকাল শুক্রবার রাজধানীর পিলখানায় বিজিবি সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন।
মহাপরিচালক জানান, সম্প্রতি দিল্লীতে শেষ হওয়া বৈঠকে দুই প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর প্রধানেরা গরু চোরাচালান বন্ধ হলে সীমান্ত হত্যা কমবে বলে একমত পোষণ করেছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছেন ২২ জন। গত সেপ্টেম্বরেই এক সপ্তাহে নিহত হয়েছেন চারজন।
এই প্রেক্ষাপটে আলোচনায় এ বিষয়টি গুরুত্ব পায় বলে জানান বিজিবির মহাপরিচালক। তিনি জানান, এবারের বৈঠকেও মূল আলোচ্যসূচি ছিল সীমান্ত হত্যা। সীমান্ত হত্যার পেছনে কী কী কারণ রয়েছে এবং কীভাবে সীমান্ত হত্যা কার্যকরভাবে বন্ধ করা যায় তা নিয়ে দুই পক্ষ আলোচনা করেছে।
দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর এই বৈঠক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী বেনারকে বলেন, “বন্ধুপ্রতিম দুটি দেশের সীমান্তে গুলি চলতে পারে না। সীমান্ত সুরক্ষার দায়িত্ব বিজিবির। তারা যদি মনে করে গরু চোরাচালান বন্ধ হলে গুলি বন্ধ হবে তবে তাই ঠিক এবং এটাই করতে হবে।”
গত ৩ অক্টোবর দিল্লীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) ৪৩ তম সীমান্ত সম্মেলন শেষ হয়। সম্মেলনে ২২ সদস্যের বিজিবি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ। আর বিএসএফ এর ২৫ সদস্যের দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাহিনীর মহাপরিচালক শ্রী কে কে শর্মা।
আজিজ আহমেদ বলেন, “গরু চোরাচালানিদের ছত্রছায়ায় অবৈধ অস্ত্র, মাদক ও স্বর্ণের চোরাচালানও হচ্ছে। সীমান্তের বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পেছনে গরু চোরাচালান প্রধান কারণ হিসেবে আমরা চিহ্নিত করেছি। তাই এটা কীভাবে রোধ করা যায়, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।”
বিজিবি মহাপরিচালক জানান, “তাদের বলেছি গরু তো তোমাদের দেশ থেকে আসে। এ জন্য ভারতের দায়িত্ব বেশি। ভারতের বিভিন্ন পক্ষগুলোকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখার অনুরোধ জানানো হয়েছে।”
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বেনারকে বলেন, “বিজিবির মতের সঙ্গে আমিও একমত। সীমান্ত দিয়ে বেপরোয়া গরু পাচারই হত্যাকাণ্ডগুলোর অন্যতম কারণ।”
ওই ব্যবসায়ী বলেন, “বাংলাদেশের পশুপালনে যে উন্নয়ন হয়েছে সেখানে ভারতীয় গরুর প্রয়োজন নেই। তাই গরুর পাচার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করলে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না।”
আইন ও সালিস কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বেনারকে বলেন, “গরু আনা নেওয়া শুধু বাংলাদেশিরা করে তা নয়। দুই দেশের লোকই এ কাজে জড়িত এবং তারা নিরস্ত্র থাকে। কিন্তু ভারত কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পুরো বিষয়টিই বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে।”
তিন বিএসএফ সদস্য নিহত, আহত ১৫৭
গরু পাচারকারীদের ‘হামলায়’ এ বছর তিনজন বিএসএফ সদস্য নিহত এবং ১৫৭ জন সদস্য আহত হওয়ার তথ্য সম্মেলনে জানানো হয়েছে বলে জানান বিজিবি মহাপরিচালক।
তিনি বলেন, প্রতিবারের মতো বিএসএফ এবারও বলেছে, তাদের লোকজন আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ে এবং তারা প্রাণঘাতী (লেথাল) অস্ত্র ব্যবহার করে না। এ কারণে চলতি বছর বাংলাদেশের চোরাকারবারিরা বিএসএফের তিন জওয়ানকে হত্যা এবং ১৫৭ জনকে গুরুতরভাবে আহত করেছে।
মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, “আমি তাদের বলেছি, তোমাদের লোকজন যেহেতু প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে না, সেখানে তো মানুষ মারা যাওয়ার কথা না। অথচ আমাদের লোকজন আক্রান্ত হলে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। কিন্তু আমরা তো মানুষ মারি না। আমরা নিয়ম মেনে চলি এবং ন্যূনতম শক্তি প্রয়োগ করি। তোমাদের লোকজন কেন বুক ও মাথায় গুলি করে?”
বিজিবি মহাপরিচালক জানান, গরু চোরাকারবারিদের সহযোগিতা করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত চার বছরে অন্তত ২৫ জন বিজিবি সদস্যকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ইয়াবার নতুন রুট
মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার হওয়ায় বাংলাদেশ এমনিতেই উদ্বিগ্ন রয়েছে। সম্প্রতি ভারতের সীমান্ত থেকে কয়েকজনকে ইয়াবাসহ আটকের পর এই দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে। তাই বৈঠকে ভারত থেকে ইয়াবা পাচারের বিষয়টি তুলেছে বাংলাদেশ।
আজিজ আহমেদ বলেন, ইয়াবা ভারতে তৈরি হয়ে বাংলাদেশে আসে, নাকি মিয়ানমার থেকে বিকল্প পথে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসে সেটি জানতে চেয়েছি। বিএসএফ মহাপরিচালক ও ভারতের মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা জানান, ইয়াবা ভারতে তৈরি হয় এমন কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। তারপরও বিষয়টি তারা যাচাই করে দেখবেন।
সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া
মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ভারত সংলগ্ন সীমান্তের ৭৯ শতাংশ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। আর বাংলাদেশ শিগগিরই ২৮২ কিলোমিটার সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ শুরু করবে।
এ বিষয়ে বিজিবির একটি প্রস্তাব জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়েছে বলে জানান তিনি। এ কাজ শুরু হবে টেকনাফ থেকে। পর্যায়ক্রমে আরও ৯৫০ কিলোমিটার সীমানায় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হবে।
মহাপরিচালক বলেন, “ইয়াবা আমাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ হলে ইয়াবাসহ অন্যান্য চোরাচালান বন্ধ হবে।”
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এবারের বৈঠকে বিজিবির পক্ষ থেকে ভারতে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশের ১২ শ অপরাধীর তালিকা বিএসএফকে দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় ছোট–বড় সব ধরনের অপরাধীর নাম আছে। বিভিন্ন সংস্থা এই তালিকা তৈরি করেছে।
“সন্ত্রাস ও চোরাচালান বিষয়ে দুই দেশেরই আইন রয়েছে। আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার এবং বিচারের মধ্য দিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করার বিধান আছে। অথচ আইনী ব্যবস্থা না নিয়ে সশস্ত্র জবাব দেওয়া হচ্ছে। বন্ধু প্রতিম দুটি দেশের মধ্যে এটা হতে পারে না,” জানান নূর খান।