পরিবেশবাদীদের আপত্তি সত্ত্বেও সুন্দরবনের কাছে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.07.13
Rampa-Power-Plant1000.jpg সুন্দরবনের কাছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদে সিপিবি–বাসদ পুরানো পল্টনের প্রগতি সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে। জুলাই ১৩, ২০১৬।
বেনার নিউজ

গত কয়েক বছর ধরে পরিবেশবাদীদের দীর্ঘ আন্দোলন আর প্রবল আপত্তির মধ্যে সুন্দরবনের কাছে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। ১৩২০ মেগাওয়াটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গত মঙ্গলবার ১৪৯ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি সই হয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের খুব কাছে নির্মিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এই বিশ্ব ঐতিহ্যের ধ্বংস বয়ে আনবে, এমন অভিযোগ তুলে চুক্তিটি বাতিলের দাবি অব্যাহত রেখেছেন পরিবেশবাদীরা।

তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হবে না বলে দাবি করছে সরকার ও নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। গবেষক, পরিবেশবিজ্ঞানী ও এ সংক্রান্ত উচ্চতর প্রকৌশল জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের পরামর্শে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার আশ্বাস দিচ্ছেন তাঁরা।

মাইলফলক মনে করছে সরকার

গত ১২ জুলাই রাতে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যালস লিমিটেডের (বিএইচইএল) সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফপিসিএল)। এর মাধ্যমে রামপালে মৈত্রী সুপার থারমাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হলো।

এই চুক্তিকে বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশ-ভারত সহযোগিতার মাইলফলক হিসেবে দেখছে সরকার। আগামী ২০১৯ সালের মধ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন শুরুর আশা করা হচ্ছে।

বিআইএফপিসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য ও বিএইচইএল’র মহাব্যবস্থাপক প্রেম পাল যাদব চুক্তিতে সই করেন।

এ সময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, ভারতের বিদ্যুৎ সচিব প্রদীপ কুমার পূজারি, বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলাসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী বলেন, “রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের বা পরিবেশের জন্য হুমকি হবে না। সরকার ও নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান মিলে সেরকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

সরকারের মতে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার কথা মাথায় রেখে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব মনোয়ার ইসলাম বেনারকে বলেন, “আগামী ২০৪১ সালে বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা হবে প্রায় ৬০ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু পর্যাপ্ত গ্যাস মজুদ না থাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।” তাঁর মতে, পরিবেশের কথা বলে অনেকেই এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

চুক্তি বাতিলের দাবি

রামপালে নির্মিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তসীমা থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। সুন্দরবনের ওপর এর পরিবেশগত প্রভাব মাথায় রেখে পরিবেশবাদীরা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে আপত্তি জানিয়ে আসছেন।

বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা তুলে ধরে পরিবেশবাদিরা বলছেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে সুন্দরবন শুধু মারাত্মক হুমকিতেই পড়বে তা নয়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। সে আশঙ্কা থেকে এটা অন্য কোথাও স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছেন তাঁরা।

একই দাবি নিয়ে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করেছে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি, সিপিবি–বাসদসহ কয়েকটি সংগঠন।

৫৩টি সদস্য সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, “রামপাল প্রকল্পটি সুন্দরবনের ধ্বংস ডেকে আনবে। তারপরও এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের অনমনীয় অবস্থান গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুন্দরবন বাঁচানোর স্বার্থে সদ্য সম্পাদিত চুক্তি বাতিলের পাশাপাশি প্রকল্পটি নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়া উচিত।”

তাঁর মতে, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে তা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ও রাসায়নিক বর্জ্যে নিশ্চিতভাবেই সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস হবে।

তবে গতকাল পর্যন্ত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পটি দেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি। সেটা ছাড়াই কীভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সম্পন্ন হতে পারে—সে বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন সুলতানা কামাল।

চার দফা দাবি

সংবাদ সম্মেলনে কমিটির পক্ষ থেকে চার দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো; অবিলম্বে মঙ্গলবার সম্পাদিত রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের  অবকাঠামোগত উন্নয়ন চুক্তি বাতিল, রামপাল কয়লভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অবিলম্বে বন্ধ ও নিরাপদ দূরত্বে স্থানান্তর, সুন্দরবন রক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন এবং সুন্দরবনের পাশে ক্ষতিকর সকল অবকাঠামোর কার্যক্রম বন্ধ করা।

উন্নয়ন হতে হবে জনস্বার্থে

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বেনারকে বলেন, “শুধুমাত্র সরকারি সমীক্ষার ওপর ভর করে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মান করা হচ্ছে, যা সুন্দরবন ও এই দেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমরা মনে করি।”

তাঁর মতে, আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সংগঠনের মাধ্যমে এ বিষয়ে সমীক্ষা পরিচালনা করতে হবে।

বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ভুক্তভোগীদের মতামত আমলে না নেওয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমরা উন্নয়ন বিরোধী নয়। তবে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও জনগণের স্বার্থ মাথায় নিয়েই উন্নয়ন করতে হবে।”

এ বিষয়ে অধিকারকর্মী খুশী কবির বেনারকে বলেন, “রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবন ও এই দেশের অনিবার্য ক্ষতি ডেকে আনবে। অথচ সে বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে সরকার মুখে উন্নয়নের কথা বলছে।”

তাঁর মতে, সরকার যদি দেশ ও জনগণের উন্নয়ন চায়, তাহলে অবশ্যই রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সরিয়ে নিতে হবে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।