নিহত জঙ্গি তামীম চৌধুরীরকে নিয়ে আইএসের সাময়িকীতে প্রবন্ধ
2016.10.06

বাংলাদেশে আইএসপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠী নিউ জেএমবির সমন্বয়ক তামীম আহমেদ চৌধুরী নিহত হওয়ার দুই মাসের মাথায় তার নাম দিয়ে আইএসের নতুন অনলাইন বহুভাষিক সাময়িকী রুমাইয়াহ–তে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। লেখাটি কবে ও কখন সে লিখেছিল, সে সম্পর্কে প্রবন্ধে বিস্তারিত কিছু বলা নেই।
লেখাটিতে গুলশানে হলি আর্টিজানে হামলার বিবরণ এবং ওই হামলায় নিহত পাঁচ জঙ্গির ছবি দিয়ে তাদের ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে আরও হামলার হুমকি দেওয়া হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বড় হামলার চালানোর সামর্থ্য বাংলাদেশের জঙ্গিদের এখন আর নেই।
দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বেনারকে বলেছেন, “আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, তাদের মেরূদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে তাদের বড় নেতাদের সবাই নিহত হয়েছে। তারা মানুষের মনে ভয় জাগাতে লম্বা–চওড়া কথা বলছে। ফাঁকা বুলি ছাড়া এটা আর কিছুই নয়।”
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের কর্মকর্তারাও একই মন্তব্য করছেন। তাঁরা বলছেন, পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গিদের শক্তিক্ষয় হয়েছে। তারা কোনো একটি প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ দেশে আইএসের সাংগঠনিক কার্যক্রম থাকার কথা অস্বীকার করে আসছে। তাদের দাবি, যারা নিজেদের আইএস দাবি করছে, তারা দেশীয় জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির নেতা–কর্মী।
আটটি ভাষায় প্রকাশিত আইএসের নতুন এই সাময়িকীর দ্বিতীয় সংখ্যা অনলাইনে ছাড়া হয় গত বুধবার। জঙ্গিদের অনলাইন তৎপরতার দিকে নজর রাখা সাইট ইন্টেলিজেন্ট গ্রুপের প্রধান রিটা কার্টজ বাংলাদেশ বিষয়ক নিবন্ধটি সম্পর্কে এক টুইটার বার্তায় বলেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম চৌধুরীকে আইএস তাদের বাংলার সামরিক শাখার সাবেক প্রধান হিসেবে পরিচয় দিয়েছে।
কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “লেখাটি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জঙ্গিবাদ দমনে কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে অনেক সফলতা এসেছে। আমরা সতর্ক আছি।”
তামীম চৌধুরীর নাম দিয়ে প্রকাশিত প্রবন্ধে গুলশান হামলা ও বছর জুড়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু পুরোহিত, সেবায়েৎ হত্যা, শিয়াদের ওপর ও গির্জায় হামলার পক্ষে সাফাই গাওয়া হয়েছে। যুক্তি হিসেবে কোনো প্রেক্ষাপটের উল্লেখ না করে কোরআন শরীফের বিভিন্ন আয়াত ও হাদিসের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর প্রায় সবই মনগড়া বলে মন্তব্য করেছে ইসলামী চিন্তাবিদেরা।
শোলাকিয়া ঈদ জামাতের গ্র্যান্ড ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ এই প্রবন্ধ সম্পর্কে বেনারকে বলেন, “এটা পড়েছি। তারা যে বাণী বা আয়াত প্রচার করছে তা মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর ও ভুলে ভরা। বিদায় হজের ভাষণের কথা ধরুন। সেখানে মহানবী (স.) বলেছেন, মুসলিম প্রধান দেশে মুসলমানরা অন্য ধর্মের মানুষের জিম্মাদার। আর জঙ্গিরা উল্টো বলছে আক্রমণের কথা, এটা তারা কোথায় পেল?”
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক এলাহী চৌধুরী ওই প্রবন্ধের সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বেনারকে বলেন, “তামীম তো পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে। সে কি করে প্রবন্ধ লেখে?”
এদিকে গুলশানে হামলাকারীদের প্রশংসা করে কথিত ওই প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ওই হামলায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে কমপক্ষে দুজন সিরিয়া, লিবিয়া ও অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রে আইএসের পক্ষে যোগ দিতে চেয়েছিল বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
তামিমের এই নিবন্ধের বিষয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার অনলাইন সংস্করণেও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বলা হয়, রুমাইয়াহ–তে তামিমের নামে প্রকাশিত নিবন্ধের বিষয়টি তারা যাচাই–বাছাই করছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে উগ্রবাদ বিষয়ক প্রোগ্রামের ফেলো অমরনাথ অমরাসিংহাম এই প্রবন্ধ সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “সত্যিকারের পরিচয় প্রকাশ করার বিষয়টি খুবই অস্বাভাবিক। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা গুলশান হামলার কৃতিত্ব নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ।”
মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ এই প্রবন্ধ সম্পর্কে বলেছেন, “আমার দৃষ্টিতে এটি পরাজিতদের বাগাড়ম্বর। তারা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।” নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও যুদ্ধরত নয়—এমন ব্যক্তিকে স্পর্শ করা নিষেধ থাকলেও জঙ্গিরা সেই শর্ত মানছে না বলে জানান ওই ইমাম।
আইএসের সাময়িকীতে প্রকাশিত লেখায় ‘অপারেশনস ইন বেঙ্গল’ শীর্ষক একটি ইনফো গ্রাফিক প্রকাশ করা হয়। এতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লা থেকে এ পর্যন্ত ২৪ টি হামলার কথা উল্লেখ করা হয়।
ইনফো গ্রাফিকে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে আইএসের হামলায় আক্রান্ত ও নিহতদের মধ্যে ৪২ শতাংশ হিন্দু ও বৌদ্ধ, ২৭ শতাংশ খ্রিষ্টান, ১৯ শতাংশ মুরতাদ ও নাস্তিক এবং ১২ শতাংশ শিয়া মতাদর্শের মানুষ রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ডের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য ম্যাচ ঘিরে কড়া সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার মিরপুর জাতীয় স্টেডিয়ামে কমান্ডো বাহিনী দিনভর মহড়া দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বেনারকে বলেন, “আইএস অধ্যুষিত এলাকাগুলোর বড় অংশ ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। বিভিন্ন দিকে পালাচ্ছে তারা। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে আরও সতর্ক থাকতে হবে।”