কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোটের সম্ভাবনায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি উত্তাল

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.01.19
Ind-politics বাম ফ্রন্ট নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কংগ্রেসের সঙ্গে নির্বাচনী ঐক্য করতে চাইছেন।
অনলাইন

রাজনীতির ময়দানে নাকি কেউ শত্রুও হয় না, মিত্রও নয়। স্বার্থের সমীকরণের অদলবদলে বন্ধুত্বও পাল্টে যায়।

বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে যেমনটা হয়েছিল। বিজেপি-র বিজয়রথ রুখতে হাত মিলিয়েছিল দীর্ঘ দিনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল আর নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড। তার ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। সমস্ত পূর্বাভাসকে মিথ্যে প্রমাণিত করে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল এমন মহাজোটবন্ধন।

পশ্চিমবঙ্গে কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে? এক কালের দুই কট্টর বিপরীতমুখী রাজনৈতিক শক্তি কংগ্রেস আর বামফ্রন্ট কি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে আসন বণ্টনের পথে হাঁটবে? রাজ্য রাজনীতি আপাতত সেই আলোচনায় সরগরম।

তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইয়ে নামতে দু’পক্ষের আগ্রহই চোখে পড়ছে। প্রথমে রাজ্য সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, এবং তার পর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রকাশ্য জনসভাতেই কংগ্রেসের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। বুদ্ধদেববাবু রীতিমত জোর দিয়ে বললেন, কংগ্রেসকে জোটের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হবে।

এর আগে, সিপিআইএম-এর সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচিত হয়ে সীতারাম ইয়েচুরি জানিয়েছিলেন, কংগ্রেস সম্বন্ধে তাঁর ছুৎমার্গ নেই। রাজনীতির গতিপ্রকৃতির কথা মাথায় রেখে যে কোনও অসাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গেই জোটে যেতে তৈরি তাঁরা।

অন্য দিকে, কংগ্রেসের তরফেও আগ্রহের অভাব নেই। প্রদেশ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র ওমপ্রকাশ মিশ্র দিল্লিতে হাইকম্যান্ডের কাছে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তাঁরাও চান যে রাজ্যে কংগ্রেস বামপন্থীদের সঙ্গে জোট করুন। জোটের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ওমপ্রকাশবাবু আশাবাদী। তাঁর মতে, জোট হলে ২৯৪ আসনবিশিষ্ট রাজ্য বিধানসভায় জোটের আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৬১, এবং তৃণমূল কংগ্রেস পাবে মাত্র ১২৬টি আসন। অর্থাৎ, জোট হলে ক্ষমতায় আসবেন তাঁরাই।

কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের প্রশ্নে উদ্যোগী হয়েছে যদিও বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিআইএম, অন্য শরিকদেরও যে তাতে আপত্তি নেই, স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাঁরা। ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ বললেন, বামফ্রন্ট যা সিদ্ধান্ত করবে, আমাদের তাতেই সম্মতি আছে। আরএসপি-র রাজ্য সম্পাদক ক্ষিতি গোস্বামী বললেন, যদিও অতীতে কংগ্রেসের চরিত্র আমরা দেখেছি, কিন্তু এখন পরিস্থিতি পরিবর্তিত। কাজেই, জোটে যেতে আপত্তি নেই। আপত্তি নেই অন্য শরিক সিপিআই-এরও।

দুই বিরোধীর এই আশাবাদকে অবশ্য বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতে নারাজ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, এই জোট নিছক সুবিধাবাদ বই আর কিছু নয়। তা দিয়ে রাজ্যের মানুষকে বোকা বানানো যাবে না।


অস্বস্তি সত্তেও জোট বাঁধতে আপত্তি নেই কারো

বিভিন্ন প্রশ্নে যে কংগ্রেসের নৈতিক অবস্থান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে বামপন্থী দলগুলির মনে, তার সঙ্গেই জোট করতে এমন আগ্রহ কেন? সেই প্রশ্নে অস্বস্তি রয়েছে রাজ্য নেতাদের মনেও। ফলে, তাঁরা কংগ্রেসের কোর্টে বল রেখেই খেলতে চাইছেন। কংগ্রেসের রাজ্য নেতাদের বেশির ভাগই অবশ্য জোটের পক্ষে।

রাজ্য প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বললেন, “অতীতেও বলেছি, তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট আমাদের কর্মী-সমর্থকরা চান না। এখনও সে কথাই বলছি। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত অবশ্যই হাইকম্যান্ডের হাতে।” প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র বললেন, “অতীতে আমরা সিপিএম-এর সঙ্গে লড়াই করেছি, কিন্তু এখন বৃহত্তর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”

নীচু তলার কর্মীরা এই জোট সম্ভাবনা নিয়ে কী ভাবছেন? সিপিআইএম-এর দমদম আঞ্চলিক শাখার সদস্য এবং দলের পূর্ণ সময়ের কর্মী সুব্রত তপাদার বললেন, “কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মেলাতে হলে যে একটুও অস্বস্তি হবে না, তেমন দাবি করব না। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের রাজত্বে পশ্চিমবঙ্গে যে নৈরাজ্য, যে অপশাসন চলছে, তা শেষ করতে হলে এখন এই জোটের পথে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই।”

কিন্তু, জোট তৈরি হলেও কি ভোটাররা মন থেকে তা মেনে নিয়ে ভোট দিতে পারবেন? একেবারে নিশ্চিত হতে পারছেন না হাওড়ার সিপিআইএম আঞ্চলিক কমিটির নেতা দেবাশিস মিথিয়া। বললেন, “দল দুটোর বিরোধের ইতিহাস এতই দীর্ঘ যে কোনও কেন্দ্রে জোটের প্রার্থী কংগ্রেসের হলে তাঁকে সিপিআইএম সমর্থকরা ভোট দেবেন কি না, অথবা বামফ্রন্টের প্রার্থী কংগ্রেস ভোটারদের ভোট পাবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে, জোট হলে তাকে সফল করার জন্য আমাদের চেষ্টা করতে হবে।”

যে জোট নিয়ে এত আলোচনা, আদৌ কি তা বাস্তবায়িত হবে? সংশয় প্রকাশ করলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “প্রথমত, সিপিআইএম-এর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব শেষ অবধি মনের জোর ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সংশয় কংগ্রেস হাইকম্যান্ডকে নিয়ে। প্রথম ইউপিএ-র থেকে বামপন্থীদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়াকে সনিয়া গাঁধী এখনও ক্ষমা করেননি।

তার ওপর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভাল। মমতার সঙ্গে আবার নীতীশ কুমার বা লালুপ্রসাদ যাদবের মতো কংগ্রেসের মিত্রশক্তির সম্পর্ক ভাল। ফলে, শেষ অবধি হাইকম্যান্ড প্রদেশ কংগ্রেসের নেতাদের মতামত অগ্রাহ্য করেই তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে চায় কি না, তা নিয়ে সংশয় থাকছে।”

জোট হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু রাজ্য রাজনীতি আপাতত এই জোটের সম্ভাবনা নিয়েই জমজমাট।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।