'আমি তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে নই, কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের স্বার্থ আগে', জানালেন মমতা

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.06.04
Ind-mamata পশ্চিম বঙ্গের মূখ্যমন্ত্রি মমতা ব্যানার্জী ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তিস্তা চুক্তির সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি,২০১৫
এএফপি

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশ সফরের আগেই ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ জানিয়ে দিলেন, সফরে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত করা হবে না। সফরের আগেই এমন ঘোষণা ভারত-বাংলাদেশ কূটনীতিতে বিরল। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সিদ্ধান্তের পিছনে কোনও বিশেষ কারণ আছে কি? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতেই কি এ বারও চুক্তি আটকে গেল?

প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিদেশ মন্ত্রকের সূত্র বলছে, মনমোহন সিংহের আমলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় তিস্তা চুক্তিটি অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমি মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ দেখাই আমার কাজ।’ জানিয়েছিলেন, তাঁর অমতে চুক্তি রূপায়নের চেষ্টা হলে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেবেন। ফলে, সে দফায় চুক্তি হয়নি।

নরেন্দ্র মোদী গোড়া থেকেই বাংলাদেশ বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলোচনার রাস্তায় হেঁটেছেন। তাঁর সচিবালয় ও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের মধ্যে সরাসরি হটলাইন যোগাযোগ তৈরি করেন। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ নিজে মমতাকে ফোন করে জানিয়েছেন, কী কী কর্মসূচি ঢাকায় নেওয়া হচ্ছে। এমনকী যে যৌথ বিবৃতি নেওয়া হবে, তা-ও মমতাকে আগাম জানিয়েই করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এ ধরনের অমীমাংসিত বিষয়ে আগামী দিনেও রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করে ভারত সরকার যে একতরফা কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না, এ কথাও জানিয়েছেন তিনি।

চুক্তিটি যে অতি জরুরি, সে কথা মনে করিয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সব্যসাচী বসুরায়চৌধুরী। তিনি বললেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনকালে বাংলাদেশ যে ভাবে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে, বিশেষত সন্ত্রাসদমনের ক্ষেত্রে, তাতে ভারতেরও দায়িত্ব, সে দেশের দীর্ঘ দিনের দাবিটি পূরণ করা। আন্তর্জাতিক প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত করতে পারে। তবে, যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিম তিস্তার জলের ওপর নির্ভরশীল, তাই এই রাজ্যগুলির সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই একটি সমাধানসূত্রে পৌঁছানো উচিত। কিন্তু দেরি করা ঠিক হবে না।’

ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা-র অর্থনীতিবিদ শুভনীল চৌধুরী বললেন, ‘প্রশ্নটা শুধু বাংলাদেশের ঋণ পরিশোধের নয়। ভারতকে যদি এশিয়ায় অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে হয়, তবে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সমানে-সমানে লেনদেনের সম্পর্ক রাখলে চলবে না। প্রয়োজন হলে নিজের স্বার্থের কথা না ভেবেই সে দেশগুলির স্বার্থরক্ষা করতে হবে। চিন যেমনটা করে। তিস্তা চুক্তিকেও এই প্রেক্ষিতেই দেখা উচিত।’

ভারতের কাছে বাংলাদেশের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক গুরুত্ব বিষয়ে কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ সহমত। স্থলসীমান্ত চুক্তি কার্যকর হলে সেটি যে অনুপ্রবেশ দমনেও সাহায্য করবে, সে বিষয়েও সন্দেহ নেই। কলকাতায় এসে তৎকালীন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন পর্যন্ত মমতাকে বলেছিলেন— দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশকে পাশে রাখা বিশেষ প্রয়োজন। বিশেষত সন্ত্রাস দমন ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের সদর্থক ভূমিকার কথা মমতা নিজেও স্বীকার করেন।

তা হলে জলবণ্টন চুক্তিতে আপত্তি কোথায়?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘আমি তিস্তা চুক্তির বিরুদ্ধে নই। কিন্তু উত্তরবঙ্গকে বঞ্চিত করে তো চুক্তি করা উচিত নয়।’ তাঁর কথায়, ‘অতীতে যে চুক্তিটি তৈরি করা হয়েছিল, তাতে বেশ কিছু ত্রুটি আছে। সেগুলি মুখ্যসচিব কেন্দ্রীয় সরকারকে জানিয়েছেন। আমি নিজে বাংলাদেশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমার বক্তব্য জানিয়ে এসেছি। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে কোনও রকম নেতিবাচক সম্পর্ক নেই। কিন্তু আলাপ-আলোচনা না-করে একতরফা কিছু করলে আমরা সেটা কিছুতেই মানতে পারব না। কারণ, আমার কাছে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ সবার আগে।’

তিস্তা চুক্তি বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান কী, দলের সর্বভারতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। একাধিক এসএমএস-এর উত্তর মেলেনি।

নাম প্রকাশ করা যাবে না, এই শর্তে পশ্চিমবঙ্গের এক বিশিষ্ট নদী বিশেষজ্ঞ জানালেন, আসল সমস্যা অন্যত্র। জলের অভাব ঘটে মূলত শুকনো মরসুমে। তখন নদীতে বড় জোর ২০০ কিউবিক ফুট পার সেকেন্ড জল থাকে। এ দিকে, তিস্তার জলের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে যে সেচপ্রকল্প রূপায়িত হয়েছে, তাতে মোট জল প্রয়োজন ১৬০০ কিউবিক ফুট পার সেকেন্ড। একটা অসম্ভব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জলবণ্টন নিয়ে তর্কের পরিবর্তে বিকল্প সেচের কথা ভাবাই কর্তব্য। নদীটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তার সব জল নিয়ে নিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে নদীর বাস্তুতন্ত্র। সেটা কোনও দেশের পক্ষেই সুসংবাদ নয়।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।