রানাঘাটের ঘটনায় আরো দু’জন গ্রেফতার, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার আভাস

কলকাতা থেকে সাহানা ঘোষ
2015.03.26
Ind-Nun রানাঘাটের ঘটনায় এলাহাবাদে খ্রিস্টান্দের শান্তি মিছিল। ছবিঃ ২২ মার্চ,২০১৫
এএফপি

ঘটনার ১২ দিন পর অবশেষে রানাঘাটের ঘটনায়  দু’জনকে গ্রেফতার করল সিআইডি। ধৃতেরা হল মুহাম্মদ সিকান্দার সেখ ওরফে সেলিম এবং গোপাল সরকার।

সিআইডি সূত্রের খবর, বুধবার  মুহাম্মদ সেলিমকে মুম্বাই থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঘটনার রাতে ১৩ ও ১৪ মার্চ চার্চ আক্রমনের সময় সেলিম হাজির ছিলো। এ দিনই ঘটনায় জড়িতদের বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে হাবরার বাসিন্দা গোপালকেও গ্রেফতার করা হয়। ধৃত দু’জনেই বাংলেদেশের বাসিন্দা। বুধবার ভোর রাতে গ্রেফতারের পরে বৃহস্পতিবার  সেলিমকে কলকাতায় আনা হয়েছে। এ দিন দুপুর ২টা নাগাদ রানাঘাট আদালতে তোলা হলে বিচারক তার ১৪ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন। এর আগে পুলিশ সন্দেহভাজন ১০ জনকে জিজ্ঞাশাবাদ করেছে।

সিআইডি সূত্রের খবর, সেলিম রানাঘাট-কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত। তবে ওই ঘটনায় সেলিমের ভূমিকা কী ছিল তা এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে জানতে পারেনি সিআইডি। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধৃত সেলিম-সহ দু’জনকেই ভবানী ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

সিআইডি সূত্রের খবর, দিন কয়েক আগে হাবরা থেকে দুই মহিলাকে আটক করা হয়েছিল। তাদেরকে জেরা করেই সেলিম এবং গোপালের খোঁজ পায় তদন্তকারীরা। পরে মু্ম্বইয়ের নাগাপাড়া এলাকা থেকে সেলিমের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনের হদিশ মেলে। সেই মতো সিআইডির একটি দল মুম্বইয়ের উদ্দেশে রওনা দেন। অন্য একটি দল হাবরায় গোপালের খোঁজ করতে শুরু করে। পরে  ভোর ৩টে নাগাদ মুম্বইয়ের পিরখানা স্ট্রিট থেকে সেলিমকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যূরোকে ঘটনার তদন্তের ভার গ্রহনের জন্য বলেছেন যদিও, কিন্তু সিবিআই এখনো তদন্ত কাজ শুরু করেনি।

গত ১৪ মার্চ রানাঘাটের একটি কনভেন্ট স্কুলে ঢুকে লুঠপাট এবং ৭৪ বছরের সন্ন্যাসিনীকে ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে দেশ জুড়ে। আলোড়ন সৃষ্টি হয় আন্তর্জাতিক মহলেও। স্কুলের সিসিটিভি ফুটেজ থেকে আট অভিযুক্তের স্পষ্ট ছবি পাওয়া গেলেও অপরাধীদের ধরার ব্যাপারে কার্যত দিশাহীন হয়ে পড়ে রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশ। বিভিন্ন এলাকায় ছবি-সহ পোস্টার লাগিয়ে এবং অভিযুক্তেরা ভিন রাজ্যে বা দেশে গা ঢাকা দিতে পারে এই সন্দেহে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি চালায় সিআইডি। ইতিমধ্যে সন্দেহভাজন ১১ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে সিআইডি। কিন্তু অভিযুক্তরা অধরাই ছিল।

বিশ্বব্যাপি তোলপার সৃষ্টি করা এই ঘটনায় অনেকে সাম্প্রদায়িক আক্রমনের গন্ধ পাচ্ছে। বিশেষ করে সাধারন ডাকাতির ঘটনা হলে তারা লুটপাট করে চলে যেতো। কিন্তু কয়েক ঘন্টা ধরে চলা তান্ডব ও ৭৪ বছরের বৃদ্ধা সন্নাসিনীকে ধর্ষণের ঘটনায় চার্চের উপর ধারাবাহিক পরিকল্পিত আক্রমনের অংশ হিসেবে দেখছেন তারা।

মাইনোরিটিস কমিশনের চেয়ারপার্সন মারিয়া ফার্নেন্দেজ বেনার নিউজকে বলেন, “ডাকাতি যদি তাদের মোটিভ হয়ে থাকে, তাহলে চার্চের টাকা-পয়সা নিয়ে দ্রুত ভেগে যাবার কথা। কিন্তু কেনো তারা ৪ ঘন্টা ধরে সময় কাটালো? আমাদের কাছে প্রমাণ আছে খ্রিস্টানদের উপসনালয়ের মর্যাদা হানী করাই ছিলো রাজ্যের বাইরে থেকে আসা আক্রমনকারীদের লক্ষ্য”।

ভারতজুড়ে কয়েক মাস ধরে চার্চের উপর ধারাবাহিক আক্রমনের শেষ ঘটনা ছিলো রানাঘাটের ঘটনা। এ মাসের শুরুতে নাভি মুম্বাইতে একটি চার্চের উপর পাথর ছোড়া হয়েছে.৩ দিনের মধ্যে পুলিশ ৪ জনকে এই ঘটনায় আটক করেছে। পুলিশ দাবি করেছে এর আগে একটি জুয়ার আখড়া তারা রেইড করেছিলো, সেই রেইডে চার্চের ভূমিকা ছিলো মনে করে এর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তারা চার্চে হামলা চালায়।

তবে মহারাস্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফাদনাভিস রাজ্যসভায় এক বিবৃতিতে বলেন, “ এই ঘটনা এমন ইঙ্গিত দেয় না যে, কোনো রাজনৈতিক দল এই আক্রমনের পেছনে আছে”।

মুম্বাই ক্রিশ্চিয়ান ইয়থ ফোরামের  প্রেসিডেন্ট আগনেলো ফার্নেন্দেস বেনার নিউজকে বলেন, “এই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরই মহারাস্ট্রে এই রকম হামলার সূত্রপাত ঘটেছে। মুম্বাইতে বহু বছর ধরে বেশ পরিমান  খ্রিস্টান বসবাস করে। কিন্তু আমরা ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি দেশব্যাপী চার্চের উপর আক্রমন শুরর পর”।

ডিসেম্বর থেকে দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় চার্চের উপর আক্রমনের ৫টি ঘটনা ঘটেছে। এইসব ঘটনায় পুলিশের দাবি, জসলা চার্চের জানালা ভেঙ্গেছে বাইরে  ছেলে-মেয়েদের খেলাধূলার কারণে। রোহিনী চার্চের আগুন ধরার ঘটনা ছিলো বৈদ্যতিক শর্ট সার্কিটের জন্য।বিকাশপুর চার্চে ভাংচূরের ঘটনা ছিলো মদ্যপ লোকজনের কান্ড।ভাসান্ত কুঞ্জের চার্চের ঘটনা সাধারন চুরির ঘটনা। দিলশাদ গার্ডেন চার্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় পুলিশ বলছে তারা এখনো তদন্ত করে দেখছে।

পুলিস আরো জানায়, এসব মোটেই সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি থেকে ঘটেনি। দিল্লির পুলিশ কমিশনার এমকে মীনা বলেন, “দিল্লিতে এ বছর হিন্দু মন্দিরেও ২৬৯টি ঘটনা ঘটেছে যা ছিলো সাধারন চুরি কিংবা লোপাটের ঘটনা”।

দিল্লির আর্চবিশপ অনিল যোশেফ টমাস কুটো জোর দিয়ে বলেন, “ আক্রমনের ধরন দেখেই বোঝা যায় এগুলো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির জন্যই করা হয়েছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থ এবং প্রার্থনার জায়গায় আগুন দেয়া হয়েছে।মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে।কিন্তু আমাদের ধর্মীয় স্থানগুলো রক্ষার জন্য কোনো কিছুই করা হয়নি। এটাই কি ‘একসাথে থাকা আর একসাথে উন্নতি’র নমুনা?” কুটো এইসব আক্রমনের পেছনে কট্ট্রর হিন্দু মৌলবাদি গ্রুপের ‘ঘর ওয়াপসি’ এজেন্ডা বা স্বধর্মে পূনঃপ্রত্যাবর্তনের এজেন্ডাই দায়ী বলে উল্লেখ করেন।

দিল্লি খ্রিস্টান কমিউনিটি চার্চ আক্রমনের বিরুদ্ধে গতমাসে কয়েকদফা প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।দিল্লির অধিবাসী লীলা যোশেফ(৪০) বেনার নিউজকে বলেন, “ আমরা কি এটাই ভেবে নেবো গত বছর বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর চার্চগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে? ভারত এখন হিন্দু রাষ্ট্রে পরিনত হয়েছে এবং সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ নিজেদের রঙও বদলে ফেলেছে”।


কলকাতার আওয়ার লেডি কুইন মিশন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল সিসটার শার্লি সেবাস্তিয়ান বেনার নিউজকে বলেন, “দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চার্চের উপর এইসব হামলার পর আমাদের কমিউনিটিতে নিরাপত্তাহীনতার শংকা জাগিয়ে তুলেছে, কিন্তু আমরা আমাদের শিক্ষামূলক মিশনের কাজ অব্যাহত রাখবো”।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।