কলকাতায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে লাইসেন্স কড়াকড়ির পক্ষে মত

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.02.09
Ind-accident কলকাতায় প্রতি বছর গড়ে সাড়ে চারশো লোক পথ দুর্ঘটনায় মারা যান
অনলাইন

কলকাতায় পাসপোর্ট পাওয়া যতখানি কঠিন, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া ঠিক ততটাই সহজ। ছবিটা উল্টো হলে ঠিক হত। —যে কেউ নন, বক্তার নাম রাজীব কুমার। সুরজিৎ কর পুরকায়স্থর উত্তরাধিকারী হিসেবে যিনি কলকাতার নগরপাল, অর্থাৎ পুলিশ কমিশনার, হলেন।

নগরপাল হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই তিনি জানিয়েছিলেন, যেহেতু ট্র্যাফিক পুলিশই শহরের মুখ, ফলে সে দিকেই প্রথম নজর দেবেন তিনি। নিজের কথা রেখেই শহরের পথ নিরাপত্তা সপ্তাহ উপলক্ষ্যে কলকাতার রাস্তায় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখ খুললেন রাজীব কুমার।

বললেন, এই শহরে কোনও ক্রমে গাড়ি চালাতে পারলেই লাইসেন্স জুটে যায়। চালকের পথ নিরাপত্তা অথবা পরিবহন-বিজ্ঞান সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণাও আছে কি না, যাচাই করার কোনও ব্যবস্থাই নেই।

নিজেই টেনে আনলেন পাসপোর্টের সঙ্গে তুলনা। বললেন, কেউ যদি এখানে জন্মায়, এখানেই বাস করে, তবে অতি সহজেই তার পাসপোর্ট পাওয়া উচিত। কারণ, সেটা তার নাগরিক অধিকার। কিন্তু, ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে গেলে জানতেই হবে পথের নিয়মকানুন। ট্র্যাফিক সিগনালের অর্থ বুঝতে হবে। কড়া পরীক্ষার পরই কাউকে লাইসেন্স দেওয়া যেতে পারে।

কেন এই কথা বললেন নগরপাল? উত্তর দিয়েছেন তিনি নিজেই। জানিয়েছেন, কলকাতায় পথ দুর্ঘটনায় প্রতি বছর বহু মানুষ মারা যান। গুরুতর আহত হন আরও অনেকে। এবং, তাঁদের সিংহভাগই তরুণ। এই ক্ষতি অপূরণীয়। দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে রাজীব কুমার উল্লেখ করেছেন পথের নিয়ম সম্বন্ধে অজ্ঞতার কথা। বলেছেন, লাইসেন্স দেওয়ার সময় যদি চালকের জ্ঞান ঠিক ভাবে যাচাই করে নেওয়া হত, তবে এড়ানো যেত অধিকাংশ দুর্ঘটনাই।

কলকাতায় প্রতি বছর গড়ে সাড়ে চারশো লোক পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। আহত হন আরও অনেকে। দিল্লি চেন্নাই বা বেঙ্গালুরুর তুলনায় সংখ্যাটি কম। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৪ সালে দিল্লিতে পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ১৩৩২ জনের, চেন্নাইয়ে ১০৪৬ জনের। সেই বছরই কলকাতায় পথ দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন ৪৩১ জন। ২০১৫ সালে কলকাতায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫০।

তবে, খড়্গপুর আইআইটি-তে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর গবেষক শুভদীপ মণ্ডল বললেন, কলকাতায় দুর্ঘটনার সংখ্যা কম হলেও ছবিটা কম ভয়াবহ নয়। কারণ, দিল্লি বা চেন্নাইয়ের তুলনায় কলকাতার রাস্তার পরিমাণ অনেক কম, রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কম। কাজেই, প্রতি এক লক্ষ গাড়িতে দুর্ঘটনার সংখ্যা হিসেব কষলে দেখা যাবে, এই শহর দিল্লি বা চেন্নাইয়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে।

কলকাতায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া ঠিক কতখানি সহজ, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বললেন জয় ঘোষাল (নাম পরিবর্তিত)। মাসখানেক আগেই লাইসেন্স হাতে পেয়েছেন তিনি। বললেন, যে ড্রাইভিং স্কুলে গাড়ি চালানো শিখেছেন তিনি, তারাই কলকাতার বেলতলায় রিজিওনাল ট্রাফিক অফিসে ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

দালাল হাজির ছিল। তার মাধ্যমেই হাতে পৌঁছে গিয়েছিল একটি বই, যাতে বিভিন্ন ট্র্যাফিক সিগনাল ও সাইনের অর্থ ব্যাখ্যা করা ছিল। এক জন এসে বলে গিয়েছিলেন, কোনগুলো মুখস্থ করতে হবে। পরীক্ষার সময় এক পুলিশ অফিসার ঠিক সেগুলো দেখিয়েই অর্থ জিজ্ঞেস করলেন। তার পর ২০০ মিটার মতো গাড়ি চালাতে হল। পরীক্ষা শেষ। এর পরই সেই ট্রেনিং স্কুলের মাধ্যমেই লাইসেন্স হাতে চলে এল।

ছবিটা ঠিক এ রকমই। বেলতলা আরটিও-র সামনে দাঁড়ালেই দালাল চলে আসবে। জানতে চাইবে, ঠিক কোন লাইসেন্স চাই। তার পর টাকার অঙ্কের রফা। লাইসেন্স পাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক দালাল জানালেন, একেবারে ওপরতলা অবধি সেই টাকার ভাগ পৌঁছোয়। কাজেই, মসৃণ ভাবে চলছে গোটা ব্যবস্থাটাই।

কলকাতার নগরপাল এই শহরের সঙ্গে উন্নত দেশের শহরগুলির তুলনা টেনেছেন। আমেরিকায় ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে কী করতে হয়? প্রায় ৪০ বছর ভার্জিনিয়ার রিচমন্ড শহরের বাসিন্দা সঞ্জন রায় জানালেন, এক বারে লাইসেন্স পাওয়া কার্যত অসম্ভব। অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে আবেদনকারীর ট্র্যাফিক জ্ঞান যাচাই করে নেওয়া হয়।

ইন্টারনেট থেকে ড্রাইভার্স ম্যানুয়াল ডাউনলোড করে সেটা কার্যত মুখস্থ করার পর ডিপার্টমেন্ট অব মোটর ভেহিকলস-এর লিখিত পরীক্ষায় বসতে হয়। সেই পরীক্ষায় পাশ করলে লার্নার্স লাইসেন্স মেলে। তাতে হাত পাকানোর পর ফের পরীক্ষা দিতে যেতে হয়। এ বার গাড়ি চালানোর পরীক্ষা। তাতে পাশ করলে তবে লাইসেন্স। ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স বের করার কথা কেউ ভাবতেও পারেন না।

কলকাতায় এমন ব্যবস্থা চালু করা যায় না? অবশ্যই যায়, বলছেন কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দীপক আইচ। তবে, তার জন্য গোটা শহরের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। পুলিশকে যেমন কঠোর হতে হবে, তেমনই মোটর ভেহিকলস বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদেরও সচেতন হতে হবে নিজেদের কর্তব্য সম্পর্কে। এবং, সাধারণ মানুষকেও বুঝতে হবে, আইন মেনে চললে আখেরে নিজেরই ভাল।

খাতায় কলমে তো সবই হয়। কিন্তু কলকাতায় পথ নিরাপত্তার মান বাড়বে কি? নতুন নগরপাল পারবেন শহরের পুরনো কু-অভ্যাস দূর করতে?

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।