অন্ডালে নব নির্মিত বিমান বন্দর থেকে দিল্লি ফ্লাইট চালু হল

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.12.08
Ind-airport দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলের অন্ডালে গড়ে ওঠা কাজি নজরুল ইসলাম এয়ারপোর্টই দেশের প্রথম গ্রিনফিল্ড বেসরকারি বিমানবন্দর।
অনলাইন

পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-রাজধানী দুর্গাপুর-আসানসোল জুড়ে গেল দেশের রাজধানী দিল্লির সঙ্গে।

দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলের অন্ডালে গড়ে ওঠা কাজি নজরুল ইসলাম এয়ারপোর্টই দেশের প্রথম গ্রিনফিল্ড বেসরকারি বিমানবন্দর। গ্রিনফিল্ড, মানে একেবারে জমি অধিগ্রহণ থেকে পরিকাঠামো তৈরি, সবই নতুন করে হয়েছে। বিমানবন্দরের প্রোমোটার বেঙ্গল এরোট্রোপলিস প্রজেক্টস লিমিটিড, এবং সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি এয়ারপোর্ট ইন্টারন্যাশনাল তার সঙ্গী।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অন্ডাল বিমানবন্দর থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার দিল্লিগামী উড়ান এআই ৭৩৩-এ সওয়ার হলেন ৭ ডিসেম্বর। ১৪৪ আসনবিশিষ্ট এই এয়ারবাস ৩১৯ বিমান প্রায় ভর্তি ছিল মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গীতে। তবে, তাঁরা কেউ টিকিট কেটে বিমানে সওয়ার হননি। বিমানবন্দরের প্রোমোটার বেঙ্গল এরোট্রোপলিস প্রজেক্টস লিমিটিড তাঁদের মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

এয়ার ইন্ডিয়া সূত্রে জানা গিয়েছে, আগামী ২১ ডিসেম্বর থেকে সপ্তাহে তিন দিন অন্ডাল থেকে দিল্লিগামী বিমান উড়বে। কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে বিমান পৌঁছোবে অন্ডালে, এবং সেখানে আধঘণ্টা বিরতির পর সেই বিমান পাড়ি দেবে দিল্লি। সংস্থার সূত্রে জানা গিয়েছে, যথেষ্ট আগে থেকে টিকিট কাটলে মাত্র পাঁচ হাজার টাকাতেই অন্ডাল থেকে দিল্লি পৌঁছোনো যাবে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি মসৃণ হলেও এই বিমানবন্দর গড়ে ওঠার পথ খুব সুগম ছিল না। ২০০৬ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এই বিমানবন্দরের পরিকল্পনা করে। তারপর জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সমস্যা হয়েছে, প্রশ্ন উঠেছে বিমানবন্দরের লাভযোগ্যতা নিয়েও। কলকাতা থেকে মাত্র ২২০ কিলোমিটার দূরে তৈরি হলে আদৌ লোকে সেই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে চাইবে কি না, সংশয় ছিল।

সেই সংশয় এখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। গত মে মাস থেকে চালু হয়েছে অন্ডাল ও কলকাতার মধ্যে বিমান পরিষেবা। গাড়িতে যে পথ পাড়ি দেওয়া যায় ঘণ্টা দুয়েকে, তার জন্য বিমানে চড়তে বিশেষ কেউ আগ্রহ দেখাননি। দিল্লিগামী বিমানেও কি যাত্রী হবে? এয়ার ইন্ডিয়ার যাতে লোকসান না হয়, তা নিশ্চিত করতে প্রোমোটার বিএপিএল একটি চুক্তি করেছে। অন্ডাল থেকে দিল্লি বিমান চালাতে যা খরচ, যাত্রিভাড়ায় যদি তার পুরোটা না ওঠে, তবে সেই ঘাটতি পুষিয়ে দেবে বিএপিএল।

তবে সংস্থার কর্ণধার পার্থ ঘোষ নিশ্চিত যে সেই প্রয়োজন হবে না। বললেন, ২১ তারিখের উড়ানের ৯০ শতাংশ আসন ইতিমধ্যেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বিমান চালানোর খরচ তোলার জন্য ৬০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হলেই যথেষ্ট। কাজেই, কলকাতা-অন্ডাল-দিল্লির বিমান লোকসানে চলবে না বলেই তাঁর বিশ্বাস। তিনি বললেন, এর পর মুম্বই ও দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শহরের সঙ্গেও বিমান সংযোগ গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

আশাবাদী আরও অনেকেই। বর্ধমানের জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন বললেন, “নিয়মিত দিল্লিগামী বিমান পরিষেবা চালু হওয়ায় দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ধাক্কায় অনেকখানি এগিয়ে গেল। এলাকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।”

একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের উচ্চপদস্থ কর্মী, দুর্গাপুরের বাসিন্দা ইন্দ্রনীল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “কলকাতা বিমানবন্দর থেকে দুর্গাপুর পৌঁছোতে যে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে, সেটা ব্যবসায়িক অঙ্কে যথেষ্ট। দিল্লি থেকে সরাসরি দুর্গাপুর পৌঁছোনো গেলে এই শিল্পাঞ্চলে লগ্নি আরও সহজে আসবে বলেই আমার বিশ্বাস। এবং, এক বার লগ্নি এলে যাত্রিসংখ্যাও বাড়তে থাকবে। তখন আর বিমানবন্দরের লাভযোগ্যতা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার ধারণা, বছর চারেকের মধ্যেই ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে যাবে।”

তবে, যত দিন না যাত্রিসংখ্যা যথেষ্ট বাড়ে, তত দিন এই বিমানবন্দরকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য অন্য সিদ্ধান্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানিয়েছেন, বিমানের জ্বালানির বিক্রয় করের ওপর রাজ্য সরকার যে ৩০ শতাংশ সারচার্জ আদায় করে, অন্ডালে আপাতত তা মকুব করে দেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রীর আশা, সস্তা জ্বালানির কারণেই অন্ডাল বিমান সংস্থাগুলির কাছে আকর্ষণীয় হবে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, এ বছর সেপ্টেম্বর মাসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠকে দাবি করেন, অন্ডালের কাজি নজরুল ইসলাম বিমানবন্দরকে ‘ক্যাটেগরি টু’ বিমানবন্দরের স্বীকৃতি দিতে হবে। জম্মু, আন্দামান-নিকোবর, লক্ষদ্বীপ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের বিমানবন্দরগুলি এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। আইন অনুসারে, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান পরিবহণ সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়া ক্যাটেগরি টু বিমানবন্দরগুলিতে বিমান পরিষেবা বজায় রাখতে বাধ্য। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, এই স্বীকৃতি পেলে অন্ডালের বিমানবন্দর অনেক দ্রুত লাভজনক হয়ে উঠতে পারবে।

তবে, সংশয় রয়েছে। দিল্লির ইকনমিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় যেমন বললেন, “সরকারি ভর্তুকি দিয়ে বিমানবন্দর চালানো যায় না। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির এখন যেমন বেহাল দশা, তাতে এই রাজ্যে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিনিয়োগ না এলে বিমানে যাত্রীও হবে না।” বস্তুত, যথেষ্ট যাত্রীর অভাবে কলকাতা থেকে একের পর এক আন্তর্জাতিক বিমানসংস্থা নিজেদের উড়ান তুলে নিয়েছে।

সংশয়ের সুর বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর গলাতেও। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, “রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর নতুন শিল্প আসেনি। বরং, পুরনো শিল্পও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিমান পরিষেবা চালু হল, খুবই ভাল কথা— কিন্তু চড়বে কে?”

আশা-নিরাশার এই দোলাচলেই পথ চলা আরম্ভ হল অন্ডালের কাজি নজরুল ইসলাম বিমানবন্দরের। তার হাত ধরেই ঘুরে দাঁড়াবে দুর্গাপুর-আসানসোল শিল্পাঞ্চল? না কি, রাজ্যের শিল্প আকালে এই বিমানবন্দরও আক্রান্ত হবে?

প্রশ্ন থাকছে। তবে, নতুন বিমানবন্দর পাওয়ার আনন্দও থাকছে পশ্চিমবঙ্গে।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।