কলকাতার যে সুর হারিয়ে যাচ্ছে
2015.08.07
এক সময় তাঁদের ছাড়া কোনও আনন্দই সম্পূর্ণ হতো না কলকাতায়। শুধু এই শহরেই নয়, গোটা দেশ জুড়েই চাহিদা ছিল তাঁদের। পাটনা থেকে দিল্লি অথবা লখনৌ থেকে মুম্বাই, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক পড়ত তাঁদের।
তাঁদের যন্ত্রে সম্মিলিত ভাবে বেজে উঠত কলকাতার সুর।
তাঁরা কলকাতার ব্যান্ড পার্টি। মধ্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিট ক্রসিং পার হয়ে মহাত্মা গাঁধী রোড ধরে বড়বাজারের দিকে এগিয়ে চললে রাস্তার বাঁ দিকে পর পর চোখে পড়বে মেহবুব ব্যান্ড, প্রিন্স ব্যান্ড, মহারাজা ব্যান্ডের দোকান। সব দোকানের ছবিই কার্যত এক রকম। প্রায়ান্ধকার ঘরে বসে আছেন কোনও প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ।
দোকানের আলমারির ঝাপসা হয়ে যাওয়া কাচের পাল্লার ভিতরে ঝুলছে বিবর্ণ পোশাকের সারি, পাশাপাশি সাজানো টুপি, পুরনো হয়ে যাওয়া হরেক বাদ্যযন্ত্র। আর দোকানের বাইরে ফুটপাথে বিড়ি ধরিয়ে বসে চলমান জনতার দিকে উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন কয়েক জন। দোকানের ভিতরের প্রৌঢ় ব্যান্ডের মালিক। আর বাইরে বসে থাকা লোকগুলো ব্যান্ডের বাদক। এক সময় যাঁদের হাতের জাদুতে এই শহরের সব আনন্দে সুরের ছোঁওয়া লাগত।
মেহবুব ব্যান্ডের মালিক শাহনাওয়াজ আলম এখন ৮২ বছরের বৃদ্ধ। বললেন, তাঁদের ব্যান্ড দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো। এই শহরের সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের উৎসবে বাজিয়েছেন তাঁরা। বিয়ে হোক বা অন্নপ্রাশন, অথবা গৃহপ্রবেশ, কোনও উৎসবেই বাদ পড়তেন না তাঁরা। বড় বাড়িতে কাজের সংখ্যা যখন কমল, তখন নতুন চাহিদা তৈরি হল— বারোয়ারি পুজোয় বাজাতে ডাক পড়ত তাঁদের।
শাহনাওয়াজের গলা ক্লান্ত শোনায়। বলেন, এখন দিন বদলে গিয়েছে। কেউ আর ডাকে না। ডাকলেও, আগের মতো পয়সা নেই। পুজোয় বড় জোর বিসর্জনের দিন ডাক পড়ে।
কেন কমে গেল এই ব্যান্ডগুলোর চাহিদা? অধ্যাপক ও জনসংস্কৃতি গবেষক আবীর চট্টোপাধ্যায় বললেন, “সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচিও বদলায়। সেই পরিবর্তন স্বাভাবিক। এই ব্যান্ডগুলো সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে পারেনি। যাঁরা বাজান, তাঁরা শিল্পী হিসেবে দক্ষ হতে পারেন, কিন্তু মূলত অশিক্ষিত। ফলে, আধুনিক সময় তাঁদের আয়ত্তের বাইরেই থেকে গিয়েছে।“
“আর একটা কথাও ভুললে চলবে না”— বললেন আবীর, “গত শতকের আশির দশকের গোড়ায় বাজারে চলে এসেছিল অডিয়ো ক্যাসেট আর লাউডস্পিকার। ফলে, যে কোনও অনুষ্ঠানে অতি সহজেই গান বাজানো যেত। ব্যান্ডের বাজনার জন্য স্বভাবতই আর কেউ বাড়তি টাকা খরচ করতে চায়নি।“
কলকাতার অভিজাত লাহা বাড়ির প্রতিনিধি অনিন্দ্য লাহা জানালেন, তাঁদের পরিবারে এখন আর ব্যান্ড ভাড়া করার চল নেই। “ও সব অন্য আমলের গল্প। আজকের দিনে আর মানায় নাকি ওই রকম ব্যান্ড?” হাসতে হাসতে বললেন তিনি।
মহারাজা ব্যান্ডের মালিক কাদির খান বললেন, এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডিস্ক জকির ডাক পড়ে। মানুষ এখন ডিজে-র গানের সঙ্গে নাচতেই অভ্যস্ত। “কম বাজেটের পুজোর ভাসানে ডাক পায় মূলত ব্যাঞ্জো বাদকরা। ব্যান্ড পার্টির আভিজাত্য আর এখন কারও চাই না।“
ইতিহাসবিদ শ্যামল সেনগুপ্ত বললেন, “এক সময় কলকাতার গণসংস্কৃতিতে ব্যান্ড পার্টির একটা মস্ত জায়গা ছিল। কোন বাড়ির অনুষ্ঠানে কত বড় ব্যান্ড পার্টি এল, তা নিয়ে চাপা প্রতিযোগিতা চলত। ঊনবিংশ শতকের কলকাতায় বাবুয়ানির একটা বড় মাধ্যম ছিল এই ব্যান্ড পার্টি। কলকাতার বাইরেও হরবখত ডাক পড়ত তাঁদের। পার্টির ভাড়াও ছিল আকাশছোঁওয়া। সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই ভাড়া দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই ব্যান্ড পার্টি মূলত বড়লোকদেরই ব্যাপার ছিল।“
জমজমাট চেহারা ছিল বাজনদারদেরও। গাঢ় লাল রঙের কোট, সেই কোটের গায়ে পিতলের কারুকাজ, মাথায় টুপি, পায়ে জুতো— সব মিলিয়ে পোশাকেই মাত হয়ে যেতেন শ্রোতারা। এই পেশায় মূলত মুসলমানরাই এসেছেন চির কাল। এখনও বেশির ভাগ বাজনদারই মুসলমান। এখনও আগের পোশাকেই রাস্তায় নামেন তাঁরা। শুধু, এখন আর পোশাকের সেই জেল্লা নেই। তাঁরাও বাজাতে আরম্ভ করার আগে গলায় ঢেলে নেন সস্তা মদ। উৎসাহে যাতে ভাটা না পড়ে, সেটুকু নিশ্চিত করতে। মহাত্মা গাঁধী রোডের ফুটপাথে বসে এক বিউগলবাদক জানালেন, আগে মদের প্রয়োজন পড়ত না। শ্রোতাদের উৎসাহেই তাঁরা জমিয়ে বাজাতেন।
কোথায় থাকেন তাঁরা? কত টাকা রোজগার করেন? প্রথমে উত্তর দিতে ইতস্তত করছিলেন শেখ আকবর। তিনি ব্যান্ডে ড্রাম বাজান। তার পর বললেন, তাঁরা বিহারের বাসিন্দা। বছরে সাত মাস সেখানেই চাষবাস করেন। আর, ইদ থেকে দেওয়ালির মধ্যে সময়টা কলকাতায় আসেন। টাকা রোজগার করতে নয়, শুধু বাজনার শখ মেটাতেই।
অনুষ্ঠানপিছু দুশো থেকে তিনশো টাকা পান তাঁরা। ব্যান্ড পার্টির ভাড়া পনেরো থেকে কুড়ি হাজার টাকা। আজ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে, যখন ব্যান্ডের বাজনার চাহিদা ছিল শহরজোড়া, তখন প্রত্যেক বাদক অনুষ্ঠানপিছু পেতেন পঞ্চাশ থেকে পঁচাত্তর টাকা। আজকের বাজারে যার দাম সাতশো থেকে হাজার টাকার সমান।
পুরো সময়টাই দাঁড়িয়ে বাজাতে হয়। বিসর্জনের মতো মিছিলে বাজালে বাজাতে হয় হাঁটতে হাঁটতেই। কলকাতার ভ্যাপসা গরমে ওই মোটা কোট-টুপি পরে বাজাতে কষ্ট হয় না? উত্তরে হাসেন আকবর। বলেন, অভ্যেস হয়ে গিয়েছে তো!
মহারাজা ব্যান্ডের মালিক কাদির খান বললেন, “ব্যান্ডের এখনও যেটুকু চাহিদা আছে, তা-ও মার খাচ্ছে পুলিশের জন্য। রাস্তায় ব্যান্ড নিয়ে বেরোতে হলে পুলিশের অনুমতি প্রয়োজন। আগে পাওয়া যেত। এখন বিস্তর ঝামেলা। অনেকেই ব্যান্ড ভাড়া করতে এসেও পুলিশি অনুমতির ঝামেলার ভয়ে পিছিয়ে যান।“ লালবাজার সূত্রে অবশ্য জানা গেল, অনুমতি পেতে খুব অসুবিধার মুখে পড়তে হয় না কাউকেই।
রাজনৈতিক দলগুলোও তাঁদের কথা ভাবেনি, অভিযোগ শাহনাওয়াজ, কাদিরদের। তাঁরা কোনও শ্রমিক সংগঠনের অংশ নন, ফলে নিজেদের দাবিদাওয়ার কথা সে ভাবে তুলে ধরার সুযোগও হয় না তাঁদের।
এখনও চাহিদা রয়েছে সানাই পার্টির। অনেক বাঙালি বিয়েতেই এখনও নহবৎ বসে। অবাঙালিদের বিয়েতে ডাক পড়ে পুরো ব্যান্ডেরও। তবু, সেই চাহিদা আগের তুলনায় যৎসামান্য। ফলে, পয়সা যেমন কমেছে, তেমনই পড়ে এসেছে বাদকদের গুণগত মানও। আগে যেমন রীতিমত দক্ষ শিল্পীরা আসতেন এই পেশায়, এখন নতুন যাঁরা আসছেন, তাঁরা নিতান্তই কাজ চালানো গোছের— আফসোস ঝরে পড়ল শাহনাওয়াজ আলমের গলায়।
তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম আসছে এই পেশায়? প্রত্যেকেই উড়িয়ে দিলেন সেই সম্ভাবনা। শাহনাওয়াজ জানালেন, তাঁর ছেলে জুতোর ব্যবসা করেন। তিনিই ছেলেকে এই পেশায় আসতে দেননি। কাদির খানের ছেলে এখনও ছোট, কলেজের ছাত্র। তাকেও এই পেশার ধারেকাছে আসতে দেবেন না, জানিয়ে দিলেন কাদির।
প্রায় দুই শতাব্দী প্রাচীন এই সব ব্যান্ডের বাজনার সুর ক্রমেই মিলিয়ে আসছে। হয়তো আর কিছু বছর পরে শহরের কোলাহলে মিলিয়ে যাবে ফ্লুট, ক্ল্যারিওনেট, বিউগল, ড্রামের সম্মিলিত বাজনার আওয়াজ। মহাত্মা গাঁধী রোডের ধারে ব্যান্ডের দোকানগুলোয় অন্য কোনও পসরা বসবে।
মুছে যাবে পুরনো কলকাতার আরও একটি অধ্যায়।