বন্ধ আংশিক সফল, তবে বিরোধীরা এখনই জোট বাঁধছে না
2015.04.30
আংশিক সফল বন্ধের সাক্ষী থাকল পশ্চিমবঙ্গ। বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ২৪ ঘণ্টার ধর্মঘটের সঙ্গেই যোগ হয়েছিল পুর-নির্বাচনে বিপুল রিগিংয়ের প্রতিবাদে বামফ্রন্ট আর বিজেপি-র বন্ধের ডাক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় থাকে, রাজ্য প্রশাসন তা নিশ্চিত করবে। বন্ধের দিন অনুপস্থিত থাকলে সরকারি কর্মীদের সার্ভিস ব্রেক হবে, জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তা-ও। দোকান-বাজার, স্কুল-কলেজ খোলা রাখতে অনুরোধ করেছিলেন তিনি। প্রায় প্রথা ভেঙেই বন্ধের দিন পরীক্ষা বাতিল করেনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তবুও, রাজ্যে অন্তত আংশিক ভাবে সফল হল ধর্মঘট।
কলকাতার রাস্তায় সরকারি বাস নামলেও তার সংখ্যা অপ্রতুল ছিল। ট্যাক্সিও ছিল কম। অন্য দিনের তুলনায় রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি কার্যত চোখেই পড়েনি। নিতান্ত বাধ্য না হলে পথে নামেননি শহরবাসী। তবে, সেটা ধর্মঘটের সমর্থনে, অশান্তির ভয়ে, নাকি টানা চার দিন ছুটি কাটানোর আকর্ষণে (আগামী কাল মে দিবসের ছুটি, তার পর শনি-রবি), সে প্রশ্ন অবশ্য থেকেই যাচ্ছে।
ধর্মঘট সফল করতে পথে নামা বিরোধী আর ব্যর্থ করতে নামা শাসক দলের কর্মীদের মধ্যে বেশ কিছু অশান্তির ঘটনাও ঘটেছে। কলকাতা পুলিশের এক অফিসার জানালেন, বেশ কয়েকটি জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা চড়াও হয়েছিলেন বন্ধ সফল করতে রাস্তায় নামা বামপন্থী কর্মীদের ওপর। দু’একটি ক্ষেত্রে পুলিশের সঙ্গেও বিবাদে জড়িয়ে পড়েন ধর্মঘটীরা। তবে, খুব বড় মাপের অশান্তির খবর নেই।
বিক্ষিপ্ত সংঘর্য অবশ্য অনেক। এ দিন সকালে, টালিগঞ্জ-কুঁদঘাট রুটের দু’টি বাসে ভাঙচুর চালানো হয় বলে অভিযোগ। হাওড়া জেলার গোলাবাড়িতে তিনটি সরকারি বাস ভাঙচুর করেন বনধ সমর্থনকারী। গোলাবাড়ি সেতুর উপর একটি বাস এবং গোলাবাড়ি থানা এলাকার সালকিয়া এবং হাওড়া পোর্ট এলাকায় ট্রাম কোম্পানির দু’টি বাস ভাঙচুর করা হয়। হাওড়া শহরেরই ফোরশোর রোডে একটি মিনি বাস লক্ষ করেও ঢিল ছোড়ার অভিযোগ উঠেছে।
ট্যাক্সি এবং অটো চালকদের বিরুদ্ধে বেশি ভাড়া চাওয়ারও অভিযোগ উঠেছে। পূর্ব শাখায় রেল চলাচল স্বাভাবিক বলে জানিয়েছে রেল। যদিও শিয়ালদহ-হাসনাবাদ শাখার বসিরহাটের ভ্যাবলা স্টেশনে রেল অবরোধ করেন বনধ সমর্থনকারীরা। তার জেরে সকাল সাতটা থেকে ঘণ্টা দেড়েক বন্ধ ছিল রেল চলাচল। নাকাল হন নিত্যযাত্রীরা। পরে রেলপুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে অবরোধ তুলে দিলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। রেল অবরোধ করা হয় শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ডায়মন্ড হারবারের কাছে বাসুলডাঙা স্টেশন। পুলিশ গিয়ে হটিয়ে দেয় অবরোধকারীদের।
পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব শাখায় দূরপাল্লার রেল চলাচল স্বাভাবিক ছিল। স্বাভাবিক ছিল মেট্রো পরিষেবাও। সেক্টর ফাইভে কর্মরত তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী মুস্তাফিজুর রহমান জানালেন, প্রত্যেক ধর্মঘটের মতো এ বারও তাঁরা গত কাল রাত থেকেই তাঁরা অফিসে ছিলেন।
বন্ধ কতখানি সফল হল, তার চেয়েও অনেক বড় প্রশ্ন অবশ্য অন্যত্র। বামপন্থীদের ডাকা বন্ধের দিনই বিজেপি যে ভাবে বন্ধের ডাক দিল, অনেকের মনেই প্রশ্ন— তবে কি শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটা অলিখিত জোট তৈরি হচ্ছে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অবশ্য বলছেন, এখনও সে কথা বলার সময় আসেনি। এই দফায় বিজেপি খানিক সুবিধা বুঝে খেলল। যেহেতু বামফ্রন্ট বন্ধের ডাক দিয়েছিল, এবং বন্ধ সফল করাতেও বামফ্রন্টের কর্মীরাই রাস্তায় নামবেন, সেটা নিশ্চিত ছিল, তাই বিজেপি কার্যত তাদের ঘাড়ে সওয়ার হল। বন্ধ সফল হলে তারা কৃতিত্বের ভাগীদার হতে পারবে, কিন্তু সফল করানোর দায় নেওয়ার প্রয়োজন হবে না।
তবে, অন্য সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘ দিন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত অর্থনীতির অধ্যাপক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, সিপিআইএম-এর মতো দলের সঙ্গে বিজেপির খাতায় কলমে জোট হওয়া অসম্ভব। দুই দলের মধ্যে আদর্শগত ফারাক বিপুল। কিন্তু, একেবারে নিচু স্তরে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অলিখিত জোট হতেই পারে। সেখানে কেন্দ্র বুঝে, প্রার্থীর সম্ভাবনা বুঝে স্থানীয় কর্মীরা ঠিক করে নেবেন, কোন প্রার্থীকে ভোট দিলে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীকে হারানো সম্ভব হবে। তাঁরা সে ভাবেই ভোট দেবেন।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি অংশ এই প্রসঙ্গে দক্ষিণ বসিরহাট বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনের প্রসঙ্গ টানছেন। কয়েক মাস আগে সেখানে জয়ী হয়েছিলেন বিজেপি-র শমীক ভট্টাচার্য। লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় বামপন্থী প্রার্থীর ভোট শেয়ার অনেকখানি কমেছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, সেখানে হঠাৎ করে বিজেপির এমন কোনও উত্থান হয়নি যাতে সেই বিপুল সংখ্যক ভোট বামফ্রন্টের বদলে তাদের দিকে যেতে পারে। এটা নিচু স্তরের বোঝাপড়ার ফল। সেই বোঝাপড়ায় স্থির হয়েছিল, সর্বশক্তিতে বিজেপি-র প্রার্থীকে জেতাতে হবে।
আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এমন অলিখিত বোঝাপড়ার সম্ভাবনা আরও বাড়বে বলেই পর্যবেক্ষকদের অনুমান। তেমন হলে তৃণমূল কংগ্রেসের চিন্তার কারণ রয়েছে।