পশ্চিম বাংলায় ক্ষুদ্র ঋণ চালুর পর এবার গরিবের ব্যাংক হলো ‘বন্ধন’
2015.08.26
৭২ বছর পর কলকাতায় ফের একটি নতুন ব্যাঙ্কের জন্ম হল। ব্যাঙ্কের কর্মিরা বাড়ি বাড়ি যাবেন ঋণ দিতে ও আমানত সংগ্রহ করতে।
১৯৪৩ সালে শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লা কলকাতায় ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখনও ভারত স্বাধীন হয়নি, ভাগ হয়নি বাংলা। তার পর একটি নতুন ব্যাঙ্ক পেতে ২০১৫ সালের ২৩ অগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল বাঙালিকে।
গত রবিবার কলকাতার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে সূচনা হল বন্ধন ব্যাঙ্কের পথ চলার। চন্দ্রশেখর ঘোষের নেতৃত্বে ফের স্বপ্ন দেখা শুরু করল বাঙালি।
২০১৪ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ভারতে দুটি সংস্থাকে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক তৈরির অনুমতি দেয়। তার মধ্যে একটি হল চন্দ্রশেখর ঘোষের প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা বন্ধন, অপরটি পরিকাঠামো উন্নয়নের আর্থিক লগ্নি সংস্থা আইডিএফসি। এর আগে শেষ ২০০৪ সালে কোনও সংস্থা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক তৈরি করার অনুমতি পেয়েছিল।
২০১৪ সালে দৌড়ে ছিল আরও অনেক সংস্থাই। সেই তালিকায় ছিল রিলায়েন্স গ্রুপ, আদিত্য বিড়লা গ্রুপ, বাজাজের মতো ওজরদার নামও। তাদের টপকে কলকাতার বন্ধন লাইসেন্স ছিনিয়ে নেওয়ায় অবাক হয়েছিল গোটা দেশই। অনুমতি পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই ব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ আরম্ভ করল বন্ধন।
রবিবার সায়েন্স সিটির অনুষ্ঠানে ব্যাঙ্কটির যাত্রার সূচনা করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ২০১৮ সালে স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত হতে পারবে বন্ধন।
১৪ বছরের পথ
বন্ধন নামক সংস্থাটির পথচলা শুরু ২০০১ সালে। দরিদ্র পরিবারের সন্তান চন্দ্রশেখর জনাদুয়েক কর্মীকে নিয়ে কোন্নগর-বাগনান অঞ্চল থেকে শুরু করেন ক্ষুদ্র ঋণের কাজ। সেই পরিষেবা থেকেই মাত্র ১৪ বছরে ব্যাঙ্ক তৈরি করে ফেললেন চন্দ্রশেখর ঘোষ। সাফল্যের মাপকাঠিতে প্রায় তুলনাহীন, স্বীকার করছেন সকলেই।
চন্দ্রশেখর ঘোষ জানালেন, দরিদ্র মানুষের কাছে ক্ষুদ্র ঋণ পৌঁছে দেওয়ার কাজ বন্ধ হচ্ছে না, বরং নতুন ব্যাঙ্ক সেই কাজে তাঁর সহায় হবে। বললেন, ‘এত দিন বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে গরিব মানুষকে ধার দিতে হত। তাতে সুদের হারও বেশি হত।
এখন বন্ধন ব্যাঙ্ক যেহেতু নিজেই আমানত নিতে পারবে, ফলে অপেক্ষাকৃত কম সুদেই ঋণ দেওয়া যাবে।’ শুধু কথায় নয়, ক্ষুদ্র ঋণের সুদের হার প্রায় দেড় শতাংশ কমিয়ে ২১ শতাংশে এনেছেন তিনি। চন্দ্রশেখর জানিয়েছেন, তাঁর সংস্থার কর্মীরা আগের মতোই মানুষের বাড়িতে পৌঁছে যাবেন। এ বার শুধু ঋণ দিতে নয়, আমানত সংগ্রহ করতেও।
বন্ধন ব্যাঙ্ক অর্থনীতির মাপকাঠিতে পশ্চিমবঙ্গের জন্য কত বড় ঘটনা? কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বললেন, আক্ষরিক অর্থেই জন্ম হল এক অসাধারণ প্রতিষ্ঠানের। যারা পরিষেবা শুরুই করছে প্রত্যন্ত গ্রামেও প্রতিটি দরজায় পৌঁছোনোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে। বড় কর্পোরেট সংস্থার বদলে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগকে পুঁজি জোগানোই যাদের পাখির চোখ।
অর্থনীতিবিদ দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বন্ধন ব্যাঙ্কের দুটো তাৎপর্য। এক, এই প্রতিষ্ঠান বাঙালিকে ফের স্বপ্ন দেখতে উৎসাহ দেবে। এখন একটা হতাশা তৈরি হয়েছে যে এই রাজ্য থেকে আর কিছু হওয়ার নয়। সেই ধারণা ভাঙবে। দুই, গ্রামে মানুষের হাতে যেটুকু টাকা রয়েছে, তা যাতে সারদার মতো চিটিংবাজ সংস্থার হাতে না চলে যায়, সেটাও নিশ্চিত করবে এই বন্ধন ব্যাঙ্ক। কাজেই, পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে বড় ঘটনা তো বটেই।’
কলকাতার এক বিশিষ্ট শিল্পপতি বললেন, ‘আগেকার বাম আমলেই হোক বা এখনকার তৃণমূল কংগ্রেসের রাজত্বে, পশ্চিমবঙ্গে ব্যবসার পরিবেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখানে লগ্নি করতে সবাই ভয় পান। আমার নিজের কথা বলতে পারি, যখনই দিল্লি-মুম্বই যাই, সেখানে সবাই পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেন। বন্ধন ব্যাঙ্ক আদ্যন্ত বাঙালি প্রতিষ্ঠান। এই ব্যাঙ্ক যদি ঠিক ভাবে চলতে পারে, হয়তো পশ্চিমবঙ্গের দুর্নাম খানিক হলেও ঘুচবে।’
বড় পুজি নিয়ে ছড়িয়ে পড়লো পশ্চিম বঙ্গে
বড় মাপেই ব্যবসা আরম্ভ করল বন্ধন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নির্দেশ অনুযায়ী, ব্যাঙ্ক চালু করার সময় হাতে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার মূলধন থাকতেই হবে। বন্ধন ব্যাঙ্কের হাতে এখই আছে ২৫৭০ কোটি টাকা। আরও ৪৮২ কোটি টাকা আসছে অল্প দিনের মধ্যেই। অর্থাৎ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ধার্য নিম্নসীমার ছ’গুণ পুঁজি হাতে নিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করল বন্ধন। মূলধন জুগিয়েছে বহুজাতিক ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন। পাশে আছে সিঙ্গাপুরের জিআইসি-ও।
রবিবারই ব্যাঙ্কের ৫০১টি শাখা চালু হল। তার মধ্যে ২২৯টি শাখা গ্রামাঞ্চলে। ১৭৯টি শাখা আবার এমন জায়গায়, যেখানে এখনও ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছোয়নি। কর্মীসংখ্যা ১৯,৫০০ জন। স্বভাবতই, ব্যাঙ্কের বেশির ভাগ শাখা পশ্চিমবঙ্গে। এই রাজ্যে বন্ধন ব্যাঙ্কের শাখার সংখ্যা ২২০। চালু হয়েছে বেশ কিছু এটিএম-ও।
সায়েন্স সিটিতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন বন্ধনের ৩০০ জন পুরনো বন্ধুও। তাঁরা বন্ধনের দীর্ঘ দিনের ঋণগ্রাহক। নতুন দিগন্তের দিকে হাত বাড়ানোর সময় তাঁদের ভোলেননি চন্দ্রশেখর ঘোষ। মঞ্চ থেকেই তাঁদের ধন্যবাদ জানালেন, বন্ধনের পাশে থাকার জন্য। তাঁরাও জানালেন, এত দিনের পুরনো বন্ধু বন্ধনের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের জন্য তাঁরা মুখিয়ে রয়েছেন।
উপকার পেতে যাচ্ছে গরিব কর্মজীবিরা
নদিয়ার শান্তিপুর অঞ্চলের বাসিন্দা পম্পা তাঁতি বন্ধনের থেকে ঋণ নিয়ে তাঁর স্বামীর তাঁতের ব্যবসায় সাহায্য করেছেন। জানালেন, বন্ধনের সদস্যপদ গ্রহণের চার সপ্তাহের মাথায় ঋণ পেয়েছিলেন তিনি। প্রথম দফায় তিন হাজার টাকা। কোনও বন্ধক রাখতে হয়নি।
তবে, ঋণ গ্রহণের জন্য স্থানীয় মহিলাদের নিয়ে দল গঠন করতে হয়েছিল। দলের এক জন অন্য জনের ওপর নজর রাখেন, যাতে কেউ ইচ্ছে করে ঋণ পরিশোধে ফাঁকি না দিতে পারেন। দলের কেউ ঋণ শোধ না করলে পরের বার আর ঋণ পাওয়া যায় না বলেই জানালেন পম্পা।
পম্পা বললেন, ‘বন্ধনের কাছে ঋণ পাওয়ায় আমাদের আর মহাজনের ওপর নির্ভর করতে হয় না। আমি দু’বার ঋণ নিয়ে শোধ করে দিয়েছি। সেই টাকায় কেনা তাঁত আমাদের সংসারের মস্ত সহায় হয়েছে।’
বন্ধনের ব্যাঙ্ক তৈরি হওয়ায় তাঁর কি কোনও লাভ হল? প্রশ্নের উত্তরে পম্পা জানালেন, ‘অবশ্যই। সারদার মতো জায়গায় টাকা রেখে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমরা বন্ধনকে বিশ্বাস করি। সেখানে আমাদের টাকা মার যাবে না।’
বন্ধনের থেকে ঋণ নেননি, এমন মানুষও বন্ধন ব্যাঙ্কের বিষয়ে আশাবাদী। কলকাতার দমদম অঞ্চলের রিকশাচালক অমল দাস বন্ধন ব্যাঙ্কের কথা জেনেছেন টেলিভিশনের খবর থেকে। তিনিও বললেন, ‘হাতে দুটো বাড়তি টাকা এলে তা নিয়েই তো সমস্যা। সারদা, রোজ ভ্যালির পর আর ওই রকম কোথাও টাকা রাখার কথা ভাবতেই পারি না। এমনি ব্যাঙ্কে গেলে ইংরেজিতে লেখার ঝামেলা। শুনেছি, বন্ধন ব্যাঙ্কের লোকরাই বাড়িতে এসে টাকা নিয়ে যাবেন। অ্যাকাউন্ট খুলতে চাই।’
স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার প্রাক্তন কর্মী দিলীপ কুণ্ডু বললেন, ‘এই নির্ভরযোগ্যতার দাম অনেক। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি এখনও অনেক মানুষের কাছেই পৌঁছোতে পারেনি। বন্ধন যদি সেই কাজটা করে, তবে সেটা মস্ত সামাজিক উপকার হবে।’
চন্দ্রশেখর ঘোষের স্বপ্নের উড়াল অবশ্য ব্যাঙ্ক তৈরিতেই শেষ হচ্ছে না। ব্যাঙ্কের উদ্বোধনের মঞ্চ থেকেই তিনি বলেছেন, ‘বন্ধনকে পৃথিবীর সেরা ব্যাঙ্ক করে তুলতে হবে।’
দুনিয়ার সেরা হওয়ার লক্ষ্যে বাঙালির এক নতুন জয়যাত্রা আরম্ভ হল।