বিহারে বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের ধস, মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয়ী
2015.11.09
বিহারের এই নির্বাচনকে ভারত জুড়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার উত্থানকালে একরকম রেফারেন্ডাম হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। বিহারের মানুষ দ্বিধাহীন চিত্তে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই ম্যান্ডেট দিয়েছে।
সব জল্পনা-কল্পনা, মিডিয়ার আগাম হিসাব-নিকাশ ও এক্সিট-পোলের ফলাফলকে মিথ্যা প্রমাণ করে বিজেপির নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটিক এলায়েন্স (এনডিএ)কে পরাজিত করে নিতিশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড, লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল ও কংগ্রেসের মহাজোট সবমিলে ১৭৮টি আসনে জয়ী হয়েছে। মোট ২৪৩ আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছে মাত্র ৫৮ আসন। নিশ্চিতভাবেই নিতিশ কুমার ৩য় বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রথিতযশা সাংবাদিক সঞ্জয় শিকদার ব্যাখ্যা করেছেন, “বিহার নির্বাচন কেবল আরেকটি নির্বাচন নয়, কয়েকটি কারণেই এই নির্বাচন জাতীয়ভাবে গুরুত্ব লাভ করেছে। দুই দশক আগেই বিজেপির সঙ্গে পাট চুকিয়েছেন নিতিশ কুমার। গত বছর মোদীর নির্বাচনে নামার পর তিনি দলবল সহ জোট বাধেন এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বী লালু প্রসাদ যাদবের সঙ্গে যা মোটেই সহজ ছিল না। পরে কংগ্রেসও এসে যোগ দিলে মহাজোট গড়ে ওঠে। মোদী-অমিত শাহ’র নেতৃত্বাধীন বিজেপির বিরুদ্ধে নিরঙ্কুশ এই বিজয় নিকট ভবিষ্যতেও জাতীয় পর্যায়ে প্রভাব ফেলবে বলা যায়”।
দ্বিতীয়ত, বিহারের এই নির্বাচনকে ভারত জুড়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার উত্থানকালে একরকম রেফারেন্ডাম হিসেবেই দেখা হচ্ছিল। জাতীয়ভাবেই সবাই অপেক্ষা করছিল সাম্প্রতিককালে দাদরির ঘটনা ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গো-মাংশের ইস্যুতে হামলার ঘটনায় বিহারের মানুষ কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। অভিনেতা শাহরুখ খানকে বিজেপি ও আরএসএস নেতাদের হুমকি-ধামকি, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও ফিল্ম মেকারদের প্রতিবাদের ঘটনাও চলছিলো। শিকদার জানান, “বিহারের মানুষ দ্বিধাহীন চিত্তে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই ম্যান্ডেট দিয়েছে”।
নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের জুটিও বড় ভুমিকা রেখেছে। বিহারের নির্বাচনকে তারা জাতীয় ঘটনায় পরিনত করেছেন। মোদী রাজ্য জুড়ে ৩০টি নির্বাচনী সমাবেশে ভাষণ দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের লম্বা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ধীরে ধীরে জাত-পাতের রাজনীতি ও শেষমেশ ধর্মের সুর চড়িয়েছেন। অমিত বলেছিলো এখানে বিজেপি হেরে গেলে পাকিস্তানে আতশ-বাজি ফুটবে। সম্মিলিত বিরোধী জোটের বিরুদ্ধে মোদী-অমিত দুজনে তাদের ব্যক্তিগত লড়াই-এ পরিনত করেন।
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক কলামিস্ট দীপক বন্দোপাধ্যায় বলেন, “বিহার নির্বাচনকে দিল্লির নির্বাচনের প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে। তথাকথিত মোদী ঢেউ সত্তেও দিল্লিতে বিজেপি মোট ৭০টির মধ্যে ৩টি মাত্র আসন পেয়েছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে মোদী-অমিতের আশা ছিলো বিহারে জিতে গেলে তাদের নেতৃত্ব অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে। কিন্তু ব্যাপক ধস ছাড়া কিছুই অর্জিত হয় নি”।
রোববারের ভোট গনণায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ’র বিরুদ্ধে বিশাল বিজয়ের ধারা পরিষ্কার হয়ে গেলো। চূড়ান্ত গনণায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। মোদী অবশেষে নিতিশকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, বিজেপি হেরে গেলেও প্রধানমন্ত্রী তার সব প্রতিশ্রুতি পূরন করবেন।
পশ্চিম বাংলা ও দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল নিতিশ কুমারকে টুইটারে আগে ভাগেই অভিনন্দন জানিয়েছেন। নিতিশ তাদের ধন্যবাদ দিয়েছেন দ্রুতই। জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে যে, বিজেপি ও কংগ্রেস ছাড়াই তৃতীয় ফ্রন্ট দাঁড়াতে পারে আঞ্চলিক দলগুলো মিলে। তবে, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন জল্পনা একটু বেশি আগে হয়ে যাচ্ছে।
অনেকে নিতিশের মুখ্য মন্ত্রীত্বের আমলের অনেকগুলো উন্নয়ন কাজকে আমলে নিয়েছেন। পাটনার রাজনৈতিক বিশ্লেষক পুস্পা রাজ জানান, তিনি মেয়েদের মধ্যে বাই-সাইকেল বিতরণ করেছেন এবং সোশাল মিডিয়ায় প্রচার চালিয়েছেন। পক্ষান্তরে, আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতের নিচু জাতের মানুষদের ভোট নিয়ে মন্তব্য করেছেন যা তাদের বিরুদ্ধে গেছে।
প্রতিচী ইন্সটিটিউটের পরিচালক কুমার রানা দেখিয়েছেন যে, নিতিশ কুমার তার ১০ বছরের সময়কালে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে ৫ গুন বাড়িয়ে ৩৫০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করেছেন। ১২ হাজার সেতু নির্মাণ করেছেন ও ২০ হাজার কিমি হাইওয়ে নির্মাণ করেছেন। এছাড়া স্বাস্থ্যখাত ও শিক্ষায় ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। উন্নয়নের ছোয়া গ্রামীন এলাকাতেও ছড়িয়েছেন।
এরপরও নিতিশ জানিয়েছেন অনেক কাজ এখনো বাকি। তার বিজয়ের প্রভাব জাতীয় রাজনীতিতে পড়বে কিনা এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি হ্যাঁ বলেছেন।
তবে সময়ই বলে দেবে ভারতের রাজনীতির পরিবর্তন কিভাবে ঘটবে, নতুন নেতৃত্বে কে আসবেন।