ব্লু ফিল্মে অভিনয়, সল্ট লেকে গ্রেফতার ২৮

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.12.22
Ind-blue বাড়ির মালিক, ছবির নির্মাতা সহ মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করেছে বিধাননগর পুলিশ।
অনলাইন

চমকে গিয়েছেন অভিজ্ঞ. পোড়খাওয়া পুলিশ কর্মীরাও।

সল্ট লেকের ডিডি ব্লকের এক অতি পরিচিত বিয়েবাড়িতে চলছিল ব্লু ফিল্মের শুটিং। জনবসতির একেবারে মধ্যে, মধ্যবিত্ত পাড়ায়। এবং, সেই ছবিতে অভিনয় করছিলেন যে তরুণীরা, তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন কলকাতার নামকরা কলেজের ছাত্রী, তেমনই আছেন গৃহবধূও। শুধু কলকাতাই নয়, পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও বেশ কয়েক জন এসেছিলেন নীল ছবিতে অভিনয় করতে।
বাড়ির মালিক, ছবির নির্মাতা সহ মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করেছে বিধাননগর পুলিশ।

সল্ট লেকের বিসি ব্লকের বাসিন্দা সুতপা সরকার বললেন, “আমি স্তম্ভিত। ভাবতেই পারছি না আমার বাড়ির পাশেই এই কাণ্ড চলছিল। ভদ্র বাড়ির মেয়েরাও যে এমন কাজে জড়িত থাকতে পারে, ভাবতেই লজ্জা করছে।”

বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দা প্রধান কঙ্করপ্রসাদ বারুই জানালেন, সল্ট লেক সিটি সেন্টারের পাশেই দিশারি নামক বিয়েবাড়িটি। সেখানেই চলছিল শুটিং। উপস্থিত ছিলেন সাত মহিলা মডেল, পাঁচ পুরুষ মডেল, দুই ফিল্ম ডিরেক্টর এবং এক সাউন্ড রেকর্ডিস্ট। এ ছাড়াও ছিলেন বেশ কয়েক জন টেকনিশিয়ান। বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতেই অভিযান চালায় পুলিশ। শুটিং চলাকালীনই গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার হওয়া মহিলারা প্রত্যেকেই দাবি করেছেন, তাঁরা জানতেন না যে এখানে ব্লু ফিল্মের শুটিং হবে। তাঁদের বলা হয়েছিল, একটি তথ্যচিত্রে অভিনয় করতে হবে। তবে, যখন তাঁরা জানলেন যে বে-আইনি নীল ছবির শুটিং হচ্ছে, তখন কেন তাঁরা শুটিং করতে অস্বীকার করলেন না, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।

তবে, কলকাতা পুলিশের এক অভিজ্ঞ অফিসার বললেন, শহর জুড়ে আখছার ব্লু ফিল্মের শুটিং চলছে। বাড়তি টাকা উপার্জনের সুযোগ তো বটেই, অনেকে শুধু মজা নিতেও জড়িয়ে পড়ছেন এই অন্ধকার জগতে। কলেজছাত্রী, গৃহবধূ থেকে থিয়েটারের অভিনেত্রী বা কল সেন্টারের কর্মী, সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে মহিলারা আসছেন এই নীল ছবির দুনিয়ায়। প্রত্যেকেরই বয়েস ত্রিশের নীচে। বয়েস যত কম, চাহিদাও ততই বেশি।

ভারতে ব্লু ফিল্ম তৈরি করা বে-আইনি। যে কোনও পথে তা বিপণন করাও নিষিদ্ধ। কিন্তু, কেউ যদি ব্যক্তিগত ভাবে ব্লু ফিল্ম সংগ্রহ করতে চান বা দেখতে চান, তাতে আইনি বাধা নেই। তবে, আইনের তোয়াক্কা না করেই ইন্টারনেটের বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক সাইটের মাধ্যমে ব্লু ফিল্মের রমরমা ব্যবসা চলছে।

সল্ট লেকে তৈরি হওয়া ব্লু ফিল্মও ছড়িয়ে পড়ত ইন্টারনেটের দুনিয়াতেই। গোয়েন্দাপ্রধান কঙ্কর প্রসাদ বারুই বললেন, সল্ট লেকের এজি ব্লকের বাসিন্দা সৌম্য শঙ্খ রায় ওরফে রাজা ছিল এই চক্রের পাণ্ডা। সে-ই সোনারপুরের বাসিন্দা সুভাষ ধর রায়কে ভাড়া করেছিল ফিল্মের শুটিং পরিচালনা করতে। দিল্লির এক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল রাজার। পাঁচ থেকে দশ মিনিটের বিভিন্ন ক্লিপিং শুট করা হচ্ছিল। শুটিং শেষ হলেই তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল দিল্লির সংস্থাটিকে। তারা সেই ক্লিপিং তুলছিল ইন্টারনেটে। সেখানে যত হিট, তত টাকা। সেই টাকা ভাগ হত দুই হিস্যায়। এক ভাগ রাখত সংস্থাটি, আর অন্য ভাগ যেত রাজার পকেটে।

রাজার কাছ থেকে পাওয়া ডায়েরির ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, এই দফায় বেশ কয়েক দিন ধরে শুটিং চলছিল। আজই ছিল শেষ পর্ব।

শুধু কলকাতাতেই নয়, শিলিগুড়ি, দিঘা, শঙ্করপুর, বারুইপুর, সোনারপুর, ডায়মন্ডহারবার থেকে ডুয়ার্স, রাজ্যের সর্বত্রই ব্লু ফিল্মের শুটিং চলছে বলে জানালেন কলকাতা পুলিশের এক অভিজ্ঞ অফিসার। তিনি বললেন, অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ টেরও পায় না যে শুটিং চলছে। তবে, উড়ো সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়েও বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতার করেছে। সম্প্রতি ডুয়ার্সের চালসায় একটি শুটিংয়ে পৌঁছে যায় পুলিশ। গ্রেফতার হয় বেশ কয়েক জন। কলকাতাতেও একাধিক বার সফল অভিযান চালিয়েছে পুলিশ।

তবে, পুলিশ মহলের মতে, গ্রেফতার হওয়ার পর জামিন পেলে, অথবা বিচারে মুক্তি পেলে অনেক মেয়েই ফিরে যান নীল ছবির দুনিয়ায়। কেন?  সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বললেন, “যৌনতা বিষয়ে সমাজের সনাতন চিন্তাভাবনা বদলাতে আরম্ভ করেছে। এখন অনেকেই শরীর বিষয়ে আর ততখানি রক্ষণশীল নন। হয়তো তাঁরা মনে করেন, যদি সাধারণ ছবিতে অভিনয় করা যায়, নীল ছবিতে শরীর দেখাতেই বা আপত্তি কী? এর থেকে যে টাকা পাওয়া যায়, তার পরিমাণ কিন্তু নেহাত কম নয়। সচ্ছল ঘরের মেয়েরাও শুধু হাতখরচের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য এই পথে হাঁটছে, এমনটাও হতেই পারে।”

কত টাকা পাওয়া যায় এই ধরনের ছবিতে অভিনয় করে? সল্ট লেকে গ্রেফতার হওয়া মেয়েরা জানিয়েছেন, প্রতিটি ক্লিপিংয়ের জন্য তাঁদের এক হাজার টাকা পাওয়ার কথা ছিল। দিনে তিনটি ক্লিপিং মানে অন্তত তিন হাজার টাকা। পশ্চিমবঙ্গের অভিনয় জগতের প্রেক্ষিতে অঙ্কটি নেহাত কম নয়। গ্রুপ থিয়েটারে তো নয়-ই, এমনকী টেলিভিশন সিরিয়ালে অভিনয় করেও প্রতি দিন এত টাকা রোজগার করা মুশকিল।

তা হলে কি টাকার অঙ্কে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধও?  অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন নারীবাদী আন্দোলনের দীর্ঘ দিনের কর্মী সোনা মিত্র বললেন, “কথাটা ভুল নয়। শরীরের অধিকার ব্যক্তিগত। তাকে কে কী ভাবে ব্যবহার করবে, সেটাও তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কিন্তু, সেই সিদ্ধান্তে নিজের সত্তাও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখা ভাল।”

সমাজের এই নতুন অসুখ আদৌ সারবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই গেল।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।