বইমেলা বাদ দিয়ে বাঙালি হয় না

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.02.05
Ind-bookfair ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের ধারে চলছে চল্লিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা। গোটা দুনিয়ার বাঙালি একে ‘কলকাতা বইমেলা’ নামেই চেনে।
অনলাইন

‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ’ বললে প্রথমেই যদি বইমেলার কথা মনে পড়ে, খুব দোষ দেওয়া যায় কি?

তুরস্কের ইস্তানবুলে সাবানসি ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অন্তত তাতে আপত্তি করবেন না। পুজো বা দীপাবলি নয়, কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য তিনি জানুয়ারি মাসের শেষটাকেই বেছে নিয়েছেন। কারণ, ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের ধারে মিলনমেলা প্রাঙ্গণে চলছে চল্লিশতম কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা। এটা অবশ্য ভাল নাম। গোটা দুনিয়ার বাঙালি একে ‘কলকাতা বইমেলা’ নামেই চেনে।

আগামী রবিবার শেষ হবে মেলা। আর, প্রবীরেন্দ্রও ইস্তানবুলের বিমানে চাপবেন সোমবার সকালেই। সাতাশ থেকে সাত, টানা বারো দিন প্রতিটি সন্ধ্যাই তাঁর মেলা প্রাঙ্গণে কাটল। এই বছর অবশ্য একটা বিশেষ কারণও ছিল। সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত হল তাঁর প্রথম বই, ‘পরিচয়ের আড্ডায়’।

তবে, যাঁদের তেমন কোনও কারণ ছিল না, তাঁরাও জমিয়ে বইমেলা উদ্‌যাপন করলেন এই ক’দিন। দুপুর থেকে সন্ধে আটটা, অনেকেরই ঠিকানা ছিল মিলনমেলা। শুধু কলকাতার বাসিন্দারাই নন, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছিলেন বহু মানুষ। যেমন আসেন প্রতি বছরই। আসানসোলের শারদীয়া ঘোষ যেমন। বললেন, ‘ছোটবেলায় বাবা আমাদের তিন বোনকে নিয়ে আসতেন বইমেলায়। সেই অভ্যাস এখনও রয়ে গিয়েছে। কত বই দেখি। কোনওটা কিনি, কোনওটা আবার পরে কেনার জন্য মনে রেখে দিই। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় যে সব প্রকাশকের বই সহজে মেলে না, মেলায় সেগুলোও পেয়ে যাই। কত সাহিত্যিকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সেটা বাড়তি পাওনা।’

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তেমনই এক পাঠকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার গল্প শুনিয়েছেন। বহু বছর আগে এক ফ্রক-পরা কিশোরী এসে তাঁর অটোগ্রাফ নিয়ে গিয়েছিল। সেই মেয়েটিই পরবর্তী কালে শীর্ষেন্দুবাবুর পুত্রবধূ হয়। এখন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ, ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা-র অধ্যাপক সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়ই সেই ফ্রক-পরা কিশোরী।

যে বইমেলাকে কেন্দ্র করে এমন উচ্ছ্বাস, তার সূচনা ১৯৭৬ সালে। মূলত কলকাতার পুস্তকপ্রেমীদের চাহিদাতেই ব্যবস্থা হয় এই মেলার। মেলার আয়োজক কলকাতার পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। গত চল্লিশ বছরে মেলা পেরিয়েছে অনেকখানি পথ। গোটা দুনিয়ায় অনেকগুলো কারণে বিশিষ্ট জায়গা করে নিয়েছে। এই মেলায় বইয়ের স্বত্ব কেনাবেচা হয় না। এখানে সাধারণ মানুষ বই কিনতে পারেন। তেমন মেলার হিসেবে কলকাতার আন্তর্জাতিক বইমেলাই দুনিয়ায় বৃহত্তম। যে কোনও গোত্রের বইমেলা হিসেবেও কলকাতা রয়েছে বিশ্বের তৃতীয় স্থানে। ফ্র্যাঙ্কফুর্ট আর লন্ডন বইমেলার পরেই তার স্থান।

আগে মেলা হত কলকাতার ময়দানে। কিন্তু, ২০০৪ সালে কলকাতা হাই কোর্ট একটি রায়ে বলে, শহরের সব মেলাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে ইস্টার্ন বাইপাসের ধারে। তার পরও কয়েক বছর মেলা আয়োজিত হয়েছিল ময়দানেই। শেষ অবধি ২০০৯ সালে তা উঠে আসে নতুন ঠিকানায়।

কলকাতার এই মেলার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অতি নিবিড়। এ বছরও বাংলাদেশের ৩২টি প্রকাশন সংস্থা কলকাতার মেলায় যোগ দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট নাট্যকার ব্রাত্য বসু বললেন, এই মেলা দুই বাংলার বাঙালিদের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে। দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ক দিনে দিনে আরও মজবুত হবে বলেই আশা প্রকাশ করেন তিনি। বইমেলায় ‘বাংলাদেশ দিবস’ পালনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তিনি বলেন, “কলকাতার বইমেলায় যোগ দিতে পেরে বাংলাদেশ গর্বিত। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ বহু পুরনো বন্ধু এবং সম্পর্কটি এই রকমই থাকবে।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কলকাতার মেলায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের বইয়ের চাহিদা যতখানি, হুমায়ুন আহমেদের বইয়ের চাহিদা তার চেয়ে একটুও কম নয়।

প্রতি বছরই বইমেলায় মূল থিম হয় কোনও একটি দেশ। এ বছরের থিম ছিল বলিভিয়া। ২৫ জানুয়ারি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই উপস্থিত ছিল বলিভিয়ার কবি মাগেলা বাদোইন।

শুধু বই-ই নয়, কলকাতার বইমেলা প্রসিদ্ধ তার সাংস্কৃতিক বহুত্বের কারণেও। মেলা প্রাঙ্গণেই ছবি আঁকেন আর্ট কলেজের ছাত্ররা, গিটার বাজিয়ে গান ধরেন অনেকে। বাউলদেরও দেখা পাওয়া যায় কখনও সখনও। লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে ভিড় জমে কবি-প্রাবন্ধিকদের। এবং, আলোচনাচক্র বসে মেলার সভাকক্ষে।

এ বছর তেমনই এক আলোচনায় হাজির ছিলেন হিন্দি ভাষার প্রসিদ্ধ কবি অশোক বাজপেয়ী। দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাড়বাড়ন্তের প্রতিবাদে যে কবি-লেখক-সাহিত্যিকরা নিজেদের সাহিত্য আকাডেমি খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম অশোক। তিনি বললেন, “দেশ হিসেবে ভারত কখনও অসহিষ্ণু ছিল না, এখনও নয়। সমস্যা হল, কিছু অসহিষ্ণু মানুষকে প্রয়োজনের তুলনায় ঢের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এবং, তাতেই ক্ষতি হচ্ছে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের।”

তবে, বইমেলা মানে যে শুধু বই, ছবি, গানের মতো সংস্কৃতি, তা নয়। পেটপুজোর ব্যবস্থাও রয়েছে। মাছভাজা থেকে হজমি-আচার-পাঁপড়, সবই দেদার বিকোচ্ছে বইমেলার চত্তরে। তাই নিয়ে ক্ষোভও আছে কারও কারও মনে। শমীন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মেলা থেকে বেরিয়ে ক্ষুদ্ধ গলায় বললেন, যত লোক বই কিনছে, তার দশগুণ বেশি লোক শুধু খাচ্ছে। নাম বদলে এটাকে খাদ্যমেলা করে দিলেই তো হয়!

তাঁর সঙ্গে অবশ্য একমত নন সংবাদপত্র কর্মী সম্রাট মুখোপাধ্যায়। নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে তিনি লিখেছেন, “ নিজের জন্য কিছু ক্লাসিক আর আড়াই বছরের অকালপক্বটির জন্য কয়েকটি শিশু বই কিনে ইতিউতি ঘুরছি। ভাবছি, এ বার কোন দিকে যাই? একটা দোকান চোখে পড়ল। সেখানে বড়ি, পাঁপড়, আচার, মুখশুদ্ধি, হজমি, কাসুন্দি— কিছু বাকি নেই। আগে বইমেলায় খাবারের স্টলের আধিক্য দেখে খুব বিরক্ত হতাম।।

বিরিয়ানি আর ফিস ফ্রাইয়ের জন্য যে গণ-হিস্টিরিয়া, তার সিকিভাগও যদি বইয়ের জন্য থাকত! এ সব ভেবে মাথা গরম হয়ে যেত। এখন অবশ্য হাসি পায়। চার দিকে ইন্টেলেকচুয়াল বাঙালি যখন অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেয়ালে মাথা ঠুকছে, তখন আমরা, নন-ইন্টেলেকচুয়ালরাই বা পিছিয়ে থাকি কেন। অপরাধীর চোখ আর সলাজ হাসি নিয়ে এগিয়ে গেলাম গুটি গুটি। বেরোনোর মুখে টের পেলাম কাঁধটা টনটন করছে। আমার ছোট্ট ঝোলা ব্যাগখানা তখন সহিষ্ণুতায় ফুলে ঢোল। মসলা পাঁপড়ের গায়ে হয়তো হেলান দিয়েছেন চার্লস ডিকেন্স বা হজমির আড়ালে লুকিয়ে পড়েছেন হ্যারিয়েট বিচার স্টো। ব্যাগের মুখ সামান্য ফাঁক করে উঁকি দিই। হাসি পায়। রাগ হয় না একটুও।”

আর মাত্র দু’দিন। তার পরই ফের শুরু হবে ২০১৭ সালের বইমেলার প্রতীক্ষা।

বাঙালির সম্বৎসরের উৎসব।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।