পশ্চিমবঙ্গে বসে বাংলাদেশে শরিয়া শাসন প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র চলছিল: এনআইএ

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.12.15
Ind-burdhaman গত বছর বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে পরিপূরক চার্জশিট পেশ করল ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি।
অনলাইন

খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ড আন্তর্জাতিক মাত্রা পেল।

২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের খাগড়াগড় এলাকায় যে বিস্ফোরণ হয়, তার তদন্তের ভার পেয়েছিল ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। গত কাল সংস্থাটি দ্বিতীয় পরিপূরক চার্জশিট পেশ করল। মামলায় অভিযুক্ত ২৮ জনের বিরুদ্ধেই দায়ের হল নতুন অভিযোগ। এনআইএ-র আইনজীবী শ্যামলকুমার ঘোষ জানিয়েছেন, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৫ ধারা অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই ২৮ জন অভিযুক্তের প্রত্যেকেই ভারতের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্কে আবদ্ধ, অথবা শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা কোনও এশীয় দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অথবা যুদ্ধের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল বলে দাবি করেছে এনআইএ।

দেশটি ভারতের প্রতিবেশী বাংলাদেশ। গত মার্চ মাসে প্রথম দফা চার্জশিট পেশ করার সময়ই এনআইএ-র এসপি বিক্রম খালাটে বলেছিলেন, এই অভিযুক্তরা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারকে সরিয়ে শরিয়া ভিত্তিক ইসলামি মৌলবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তবে, প্রথম দফার চার্জশিটে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগে আনলফুল অ্যাকটিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট-এ মামলা দায়ের করা হয়েছিল।

সোমবার কলকাতার মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে প্রায় ৩৫০ পাতার ওই চার্জশিট পেশ করেছে এনআইএ। সংস্থার আইনজীবী শ্যামলকুমার ঘোষ ও তমাল মুখোপাধ্যায়  জানান, অভিযুক্তরা জাল ভারতীয় পাসপোর্ট, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড তৈরি করেছিল বলে তাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৬৮ ও ৪৭১ নম্বর ধারাতেও অভিযোগ আনা হয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই মামলায় এখনও পর্যন্ত ৬৬ হাজার ৭৫৩ পাতার নথি আদালতে জমা দিয়েছে এনআইএ। এখনও পর্যন্ত ৪০০ জনকে সাক্ষী হিসেবে পাওয়া গিয়েছে।

বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, সঙ্গে আর্থিক জরিমানা।

এনআইএ-র দাবি, জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি-র মূল নিশানা বাংলাদেশ হলেও ভারতে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে নিজেদের পরিকল্পনায় আরও এগোতে চেয়েছিল জেএমবি। পশ্চিমবঙ্গের তিনটি জেলা নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য ছিল জেএমবি জঙ্গিদের। বাংলাদেশে সাফল্য মিললে জেএমবি ধীরে ধীরে ভারতেও সেই লক্ষ্যে এগোত।

বাংলাদেশের পরে মায়ানমারেও শরিয়াভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা ছিল জেএমবি-র। জানা গিয়েছে, সে দেশে বিক্ষুব্ধ রোহিঙ্গা মুসলিমদের হাত ধরেই অনুপ্রবেশ করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।

ঘটনার তদন্তভার হাতে নেওয়ার পর থেকে এখনও অবধি মোট ২৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট পেশ করেছে এনআইএ। গ্রেফতার হয়েছে ১৮ জন। তার মধ্যে চার জন বাংলাদেশি নাগরিক। চার্জশিটে নাম আছে অথচ এখনও পলাতক, এমন দশ জনের মধ্যে নয় জনের বিরুদ্ধেই হুলিয়া জারি করা হয়েছে। এনআইএ সূত্রের খবর, আরও নয় সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে এখনও চার্জশিট দাখিল করা হয়নি।

এই চক্রের মূল পাণ্ডা নুরুল হক, ওরফে নইম। গত জুন মাসে হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চল থেকে গ্রেফতার হয় নইম। তার পরই জানা যায়, আদতে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা নইম বাংলাদেশের জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমবি-র সদস্য, এবং একাধিক বার বাংলাদেশে গিয়ে বোমা বানানো ইত্যাদিতে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিল।

খাগড়াগড়ে পুরোদস্তুর বোমা তৈরির কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনাও ছিল জেএমবি-র, দাবি করলেন এনআইএ-র এক আধিকারিক। সহজে কথা মানানো যায়, এমন লোকদের মগজধোলাই, তাদের থেকে বেছে নতুন নতুন জেএমবি-র সদস্য নিয়োগ, বর্ধমানের শিমুলিয়া ও মুর্শিদাবাদের মুকিমনগরের মতো মাদ্রাসা এবং আরও কয়েকটি গোপন ডেরায় তাদের প্রশিক্ষণ, শিমুলিয়া ও মুকিমনগর-সহ কয়েকটি মাদ্রাসার দরিদ্র পড়ুয়াদের সাহায্যের জন্য অর্থ সংগ্রহ— এই সবই ছিল পরিকল্পনার অঙ্গ। তবে শেষ পর্যন্ত খাগড়াগড়ের ডেরায় বিস্ফোরণ ও তদন্তে পর পর ধরপাকড়ে সব বানচাল হয়ে যায় বলে গোয়েন্দাদের দাবি।

কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার দীপক আইচ বললেন, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের অপরাধীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক যে বেশ ঘনিষ্ঠ, সে কথা এত দিনে প্রমাণিত। খাগড়াগড় কাণ্ডের তদন্ত স্পষ্ট করে দিয়েছে যে সেই সংযোগ উভয় দেশের পক্ষেই সমান ক্ষতিকারক। ফলে, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা বৃদ্ধি, প্রয়োজনে যৌথ অভিযান ইত্যাদির পথে হাঁটা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।

দিল্লির শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির গবেষক অরিজিৎ দাস বললেন, সাম্প্রতিক কালে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া বেড়েছে। বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রূপায়িত হয়েছে। আর্থিক সম্পর্কও দৃঢ়তর হচ্ছে। ফলে, অনুমান করা চলে, জেএমবি-র মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশদুটি পরস্পরের পাশে থাকবে। তবে, বাংলাদেশে যে ভারত-বিরোধী শক্তি রয়েছে, তারাও এই নতুন সুসম্পর্ক নষ্ট করার জন্য আরও বেশি সক্রিয় হবে বলেই আশঙ্কা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।