বোনের মৃত্যুর ৬ মাসেও সৎকার করলো না, বাবার আত্নহত্যা, স্তম্ভিত কলকাতাবাসী

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.06.12
Ind-family কলকাতার শেকসপিয়র সরণি থানার রবিনসন স্ট্রিটের এই বাড়িতেই পার্থ দে'র দিদির কঙ্কালসার দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ১১ জুন,২০১৫
এএফপি

দিদির মৃতদেহের পাশে ছ’মাস কাটিয়ে দিলেন কলকাতার শেকসপিয়র সরণি থানার রবিনসন স্ট্রিটের বাসিন্দা পার্থ দে। যেন আলফ্রেড হিচককের ‘সাইকো’ ছবির চরিত্রটিই উঠে এল কলকাতায়। গোটা শহর ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত।

বাড়ির মালিক, পার্থর বাবা অরবিন্দ দে (৭৭) ১০ জুন বাড়ির শৌচাগারে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ধোঁয়া বেরোতে দেখে বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী চিৎকার করায় প্রতিবেশীরা জড়ো হন। পার্থ তাঁদের বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত পুলিশে খবর দেওয়া হয়। ফ্ল্যাটে ঢুকে পুলিশ দেখে, খাটে শোওয়ানো একটি কঙ্কাল। তার গায়ে শীতের পোশাক, কম্বল চাপা দেওয়া। পাশেই পড়ে আছে প্রচুর শুকনো ফল, পচা খাবার। পার্থ সেই কঙ্কালটি দেখিয়ে বলেন, ‘ওই তো আমার দিদি’। মেঝেতে পড়ে রয়েছে দুটি কুকুরের কঙ্কালও।

পার্থর বয়ান থেকে জানা গিয়েছে, তাঁর দিদি দেবযানী দে (৪৬) গত ডিসেম্বরে মারা যান। তাঁর পোষা দুটি ল্যাব্রাডরের মৃত্যুর শোক সহ্য করতে না পেরেই নাকি দেবযানী খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেন, এবং তাতেই ক্রমে তাঁর মৃত্যু হয়। পার্থ এবং তাঁর বাবা মৃতদেহ সৎকার করেননি।

পার্থর বাবা অরবিন্দ দে এক সময় বেঙ্গালুরুর একটি সংস্থায় উচ্চপদস্থ কর্তা ছিলেন। তাঁদের পরিবার উচ্চবিত্ত। ২০০৫ সালে তাঁর স্ত্রী আরতি দে-র মৃত্যুর পর থেকেই তাঁরা সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করে দেন। দেবযানী ও পার্থ দু’জনেই ইঞ্জিনিয়র। পার্থ বিদেশে একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। তবে, দেবযানী কলকাতার একটি নামী স্কুলে সংগীত শিক্ষিকার চাকরি করতেন। মায়ের মৃত্যুর পর দুই ভাইবোনই চাকরি ছেড়ে স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হন।

বাড়ির নিরাপত্তারক্ষীরা জানিয়েছেন, অন্য কারও প্রবেশাধিকার ছিল না রবিনসন স্ট্রিটের দে বাড়িতে। কোনও গৃহভৃত্য বা পরিচারিকাও ছিল না। রোজকার খাবারদাবার বাইরের হোটেল থেকে এনে দিতেন নিরাপত্তারক্ষীরা। তবে, তাঁরাও ফ্ল্যাটে ঢুকতে পেতেন না। তবে, গত মে মাসে পার্থ তাঁর বেশ কয়েক জন আত্মীয়কে নিজের জন্মদিন উপলক্ষে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁরা কেউ কোনও গন্ধ পাননি বলেই পুলিশকে জানিয়েছেন।

মনস্তত্ত্ববিদরা বলছেন, এই ট্র্যাজেডি এক গভীর মানসিক বিকারের ফল। শুধু পার্থ নন, মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন তাঁর বাবাও। নয়তো, তিনি কেন মেয়ের দেহ সৎকার না করার মতো অস্বাভাবিকতায় সম্মতি জানিয়েছিলেন? মনস্তত্ত্ববিদ মোহিত রণদীপ বললেন, ‘যাঁরা সামাজিক ভাবে বিচ্ছিন্ন, তাঁদের মধ্যে অনেক সময় পরস্পরকে আঁকড়ে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এমন অবস্থায় তাঁদের কারও মৃত্যু হলে সেই বিচ্ছেদ সহ্য করার ক্ষমতা অন্যদের থাকে না। ফলে, তাঁরা চরম অস্বাভাবিক কাজ করে বসেন।

‘ভেবে দেখুন, দেবযানীর মৃত্যুও হয়েছিল কুকুরের শোকে। কুকুরের গ়়ড় আয়ু বড়় জোর ১৪ বছর। সাধারণ ভাবে আমরা সেই পোষ্যের মৃত্যুর জন্য তৈরিই থাকি। কিন্তু, দেবযানী সম্ভবত তাঁর কুকুরের সঙ্গে সম্পর্কটিকে পোষ্যের সঙ্গে মালিকের সম্পর্কের চেয়ে বেশি ভেবেছিলেন। সেটাও নিঃসঙ্গতারই ফল।’

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার বলছেন, ‘এই সামাজিক নিঃসঙ্গতাও মানুষ নিজেদের ‘ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডার’কে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই তৈরি করে নেয়। মৃতদেহকে আঁকড়ে থাকা যে অস্বাভাবিক, সেটা পার্থরা অবচেতনে জানতেন। কিন্তু, তাঁদের ডিলিউশন ছিল যে দেবযানী বেঁচে আছেন। বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বললে পাছে এই ধারণা ধাক্কা খায়, তাই তাঁরা নিজেদের একেবারে গুটিয়ে রেখেছিলেন।’

সমাজতত্ত্বের অধ্যাপিকা অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘এটা শুধু একটি পরিবারের ঘটনা নয়। হয়তো রবিনসন স্ট্রিটের দে পরিবারের ক্ষেত্রে ঘটনাটি চরম আকার ধারণ করেছে, কিন্তু আজকের এই নিউক্লিয়ার পরিবারের যুগে নিঃসঙ্গতা ক্রমে মহামারীর আকার ধারণ করছে। আগে যে কোনও দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জন্য পাশে অনেক আপন জনকে পাওয়া যেত। এখন ক্রমে সেই মানুষগুলোর সংখ্যা কমছে। হয়তো মায়ের মৃত্যুর পর তেমন আপনজনের আশ্রয় পেলে পার্থ-দেবযানীদেরও এই পরিণতি হত না।’

তবে, অনেকগুলো প্রশ্নও উঠছে। এক তদন্তকারী অফিসার জানালেন, মৃতদেহে পচন ধরলে সেই গন্ধ বাইরে ছড়াবে না, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশেষত মে মাসে অনেকে পার্থদের বাড়িতে এসেছিলেন। তাঁরাও কিছু টের পেলেন না, এটা অস্বাভাবিক ঠেকছে।   ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, মাত্র ছ’মাসে কোনও মৃতদেহ এমন কঙ্কালে পরিণত হয় না। তার জন্য অনেক বেশি সময় লাগে।

ফলে, রবিনসন স্ট্রিটের রহস্য ঘোরতর হচ্ছে। উত্তরের চাবিকাঠি যাঁর কাছে, সেই পার্থ দে আপাতত গোবরা মানসিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।