গজল সম্রাট গুলাম আলির অভিমান ঘোচাল কলকাতা

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.01.13
Ind-ghulam গজল সম্রাট গুলাম আলিকে কলকাতায় অভ্যর্থনা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
অনলাইন

আমার মন খুব বিষণ্ণ হয়ে ছিল। আজ সেই বিষণ্ণতা শেষ হল।

তাঁর কথা শেষ হতেই হাততালিতে ভেঙে পড়ল নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম। ১২,০০০ আসনবিশিষ্ট প্রেক্ষাগৃহে তখন ১৫,০০০ মানুষের ভিড়। এবং, বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আরও অজস্র মানুষ। তাঁদের হাতে প্রবেশপত্র রয়েছে, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহে তিলধারণের জায়গা না থাকায় পুলিশ তাঁদের প্রবেশের অনুমতি দেননি।

ব্যতিক্রমী মুহূর্ত। অবশ্যই। ১২ জানুয়ারি কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে ইতিহাস রচিত হল যে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগকে সফল করে তাঁর আমন্ত্রণে কলকাতায় গাইতে এলেন পাকিস্তানি গজল সম্রাট উস্তাদ গুলাম আলি।

গত অক্টোবরে হিন্দুত্ববাদী শিবসেনার হুমকিতে মুম্বাই থেকে অনুষ্ঠান না করেই ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। হতাশ শিল্পী বলেছিলেন, আর কখনও ভারতে গাইতে আসবেন না তিনি। তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে কলকাতায় গাইতে আমন্ত্রণ জানান। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, উত্তরপ্রদেশের অখিলেশ যাদবও ঘোষণা করেন, তাঁরা নিজের নিজের রাজ্যে নিয়ে আসবেন গুলাম আলিকে। শেষ পর্যন্ত সফল হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই।

ভারতের সঙ্গে গুলাম আলির সম্পর্ক বহু দিনের। তাঁর শিক্ষা ভারতীয় সংগীত জগতের ধ্রুবতার বড়ে গুলাম আলি খান সাহেব ও তাঁর তিন ভাইয়ের কাছে। দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতের বিভিন্ন শহরে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন গজলের বাদশাহ। কলকাতায় আসছেন ১৯৮১ সাল থেকে। তাঁকে যে ভারতে পাকিস্তানি বলে গাইতে দেওয়া হবে না, ভাবতে পারেননি এই বিশ্ববরেণ্য শিল্পী। তাঁর সেই বেদনা কলকাতার অনুষ্ঠানের মঞ্চে বেরিয়ে এল। বললেন, এই শহরে তো কত বার এসেছি। আজ মনে হচ্ছে, বুঝি পঞ্চাশ বছর পরে এলাম।

হয়তো সেই বেদনা থেকেই তিনি প্রথম গানই ধরলেন, “ফাসলে য়্যায়সে ভি হোঙ্গে, ইয়ে কভি সোচা না থা...”— দূরত্ব যে কখনও এমন হতে পারে, আগে কখনও সে কথা ভাবিনি। তার খানিক পরে ধরলেন আরও একটি গজল, যাতে রয়েছে সেই অমোঘ পঙক্তি, “নফরতোঁ কি তির খা কর, দোস্তোঁ কি শহরমে, হমনে কিস কিসকো পুকারা, ইয়ে কাহানি ফির সহি...”— বন্ধুর শহরে যখন ঘৃণার তিরে আহত হয়েছিলাম, তখন কাদের ডেকেছিলাম (এবং সাড়া পাইনি), সেই কথা না হয় আপাতত উহ্যই থাকুক। শিল্পীর বেদনা বুঝি এই ভাবেই সামনে আসে।


মমতা বললেন, সংগীতের কোনও সীমানা হয় না

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শিল্পী তুলনা করলেন দেবী সরস্বতীর সঙ্গে। মুখ্যমন্ত্রী আবার বললেন, সংগীতের কোনও সীমানা হয় না। দেশের গণ্ডিতে সংগীত আবদ্ধ নয়। গুলাম আলিকে আবার কলকাতায় ফিরে আসতেই হবে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক মহেশ ভাট। বললেন, গুলাম আলিকে ভারতের মঞ্চে ফিরিয়ে এনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মিরাকল করে দেখিয়েছেন।

কলকাতার শ্রোতারা প্রাণ ভরে শুনলেন গজল সম্রাটের গান। উস্তাদও বললেন, বিশ্বের বহু শহরে তিনি গান গেয়েছেন বটে, কিন্তু সবচেয়ে ভাল লাগে কলকাতায় গাইতেই। তাঁর কণ্ঠে যখন হাঙ্গামা অথবা চুপকে চুপকের মতো জনপ্রিয় গান উঠে এসেছে, প্রেক্ষাগৃহের দর্শক স্বতঃস্ফূর্ত হাততালিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, শিল্পীর কথাটা নেহাত কথার কথা নয়। সত্যিই কলকাতা তাঁর গানের কদর বোঝে।

অনুষ্ঠানে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কলকাতা বেতারের সুরকার দিলীপ দাস। বললেন, “এই মাপের শিল্পী গোটা দুনিয়াতেই খুব কম হয়েছে। এমন বেমিসাল লয়দার গায়ক আর নেই। বয়স তাঁর গলার অনেকখানি কেড়ে নিয়েছে বটে, কিন্তু পুরনো মেজাজ রয়েছে ষোল আনা।” সেই মেজাজেই মজল কলকাতা।

তবে, বেসুরও যে বাজেনি এই অনুষ্ঠান ঘিরে, তা নয়। অবশ্য, এমন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাজনীতির তরজা হবে, তা বোধ হয় স্বাভাবিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টতই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন, মুম্বাইয়ে যা-ই হোক না কেন, কলকাতার বুকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কোনও ঠাঁই নেই। স্বভাবতই, কথাটা সবচেয়ে বেশি বেজেছে ভারতীয় জনতা পার্টির কানে।

বিজেপি-র পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বললেন, গুলাম আলিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সস্তা সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি করছেন। ত্রিপুরার রাজ্যপাল এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের দীর্ঘকালীন সংঘসেবক তথাগত রায় আরও এক ধাপ এগিয়ে টুইটারে মন্তব্য করেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ এক জন পাকিস্তানিকে কলকাতায় ডেকে এনে সম্বর্ধনা দিয়ে গান গাওয়াচ্ছেন। অথচ, পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালি হিন্দু যে পরিমাণ নির্যাতিত হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে আর কাউকে তেমনটা সহ্য করতে হয়নি।”

টুইটারে অনেকেই টেনে এনেছেন পাঠানকোটের সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলা এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার কালিয়াচকের সাম্প্রদায়িক অশান্তির কথাও। এক জন লিখেছেন, “যখন পাঠানকোটে আমাদের বীর সৈনিকরা নিহত হচ্ছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এক পাকিস্তানির গজল শুনছেন। আমি বাক্যহারা!”

এই প্রসঙ্গগুলো উঠবে, প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু, কলকাতা যে ভাবে আপ্লুত হল গুলাম আলির গানে, তাতে একটা কথা স্পষ্ট— এখনও দেশের সাধারণ মানুষ জানেন, কার কোন পরিচয়টাকে গুরুত্ব দিতে হয়। গুলাম আলি মানে যে উগ্রপন্থা নয়, বরং প্রাণ ভরিয়ে দেওয়া গান, এই কথা বুঝতে ভারতের মানুষের আজও কোনও সমস্যা হয় না। সমস্যা শুধু রাজনীতিকদেরই, যাঁরা কোনও ঘটনাকেই বাঁধা ছকের বাইরে দেখতে পারেন না।

কলকাতা অভিমান ঘোচাল গজল কিংবদন্তীর। ভারতের মাটিতে ফের কবে গাইতে আসেন তিনি, কোন শহরে, আপাতত সেই অপেক্ষাতেই থাকলেন দেশের সংগীতপিপাসু মানুষ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।