দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে স্বাস্থ্যের তেমন উন্নতি হয়নি, জানাল সমীক্ষা
2016.02.02
শিশু ও মহিলাদের স্বাস্থ্যের প্রশ্নে কি পিছিয়েই থাকবে পশ্চিমবঙ্গ? চতুর্থ জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হওয়ার পর রাজ্য জুড়ে সেই প্রশ্ন উঠছে।
গোটা দেশের মোট এগারোটি রাজ্যে নমুনা সমীক্ষা চালানোর পর তৈরি হয়েছে চতুর্থ জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা। প্রায় দশ বছর পর ফের এই সমীক্ষা হল। ভারতের জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এই সমীক্ষাটিকেই সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন গবেষকরা।
সমীক্ষার ফল বলছে, পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ বছরের চেয়ে কমবয়সী শিশুদের ৫৪.২ শতাংশ রক্তাল্পতায় ভোগে। ২০০৫-০৬ সালে এই অনুপাতটি ছিল ৬১ শতাংশ। অর্থাৎ, গত দশ বছরে রক্তাল্পতায় ভোগা শিশুর অনুপাত কমেছে মাত্র সাত দশমিক বিন্দু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উন্নতি মোটেই সন্তোষজনক নয়।
মহিলাদের অবস্থা শিশুদের তুলনাতেও খারাপ। সব বয়সের মহিলাদের মধ্যে ৬০ শতাংশই ভোগেন রক্তাল্পতায়। গর্ভবতী মহিলাদের মধ্যেও রক্তাল্পতায় ভোগেন প্রতি দু’জনে এক জন।
খ্যাতনামা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বেনার নিউজের প্রশ্নের জবাবে বললেন, কোনও মতেই এই পরিস্থিতি গ্রহণযোগ্য নয়। গর্ভবতী মহিলারা যাতে নিয়মিত আয়রন সাপ্লিমেন্ট পান, সরকারি স্তরে বহু পূর্বেই সেই নির্দেশ জারি করা আছে। তবুও এমন অবস্থা! অনুমান করা চলে, স্বাস্থ্যকর্মীরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট তৎপর হলে ছবিটা এত খারাপ হত না।
পরিসংখ্যানও তা-ই বলছে। দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে গর্ভবতী মহিলাদের মাত্র আঠাশ শতাংশ নিয়মিত ফলিক অ্যাসিড ও আয়রন সাপ্লিমেন্ট পেয়েছেন। গর্ভকালীন সার্বিক যত্ন পেয়েছেন আরও কম মহিলা, কুড়ি শতাংশের কাছাকাছি। চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ নামক অসরকারি সংস্থার পূর্ব ভারতের অধিকর্তা অতীন্দ্র নাথ দাস এক সংবাদ সংস্থার প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে গর্ভবতী মহিলাদের জন্য উন্নত মানের স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনও স্বপ্নমাত্র।
কোথায় আটকে গেল এই রাজ্য? অর্থনীতিবিদ সীমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সম্ভাবনার কথা তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, “পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাচ্ছে, কোনও ক্ষেত্রেই গত দশ বছরে খুব একটা উন্নতি হয়নি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পাঁচ বছরের কমবয়সীদের মধ্যে ২০০৫-০৬ সালে, অর্থাৎ তৃতীয় জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার সময়, উচ্চতার তুলনায় কম ওজনসম্পন্ন শিশুর অনুপাত ছিল ৪৪.৬ শতাংশ।
দশ বছর পরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩২.৫ শতাংশে। এই একই সময়কালে ওজনের তুলনায় কম উচ্চতার শিশুর অনুপাত ১৬.৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০.৩ শতাংশ হয়েছে। এবং, সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক তথ্য হল, এই রাজ্যে প্রতি তিন জন শিশুর মধ্যে এক জনের ওজন বয়েসের তুলনায় গুরুতর রকম কম। দশ বছর আগে এই অনুপাত ছিল ৩৭ শতাংশের কাছাকাছি। অন্য ক্ষেত্রেও ছবিটা একই রকম।
“এই প্রবণতার একটা কারণ হতে পারে, এই সময়েই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি একটা টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। ফলে, শিশু ও মহিলাদের মতো সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশের স্বাস্থ্য নিয়ে মাথা ঘামানোর অবকাশ রাজনীতিকদের হয়নি। তার ফল পড়েছে পরিসংখ্যানে।“
উত্তর চব্বিশ পরগনার গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী কবিতা দাস বললেন, “স্বাস্থ্যকর্মীদের গাফিলতি নেই, সে কথা বলব না। তবে আমাদের, অথবা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের যে পরিস্থিতিতে কাজ করতে হয়, সেটাও আদর্শ নয়। যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর্মী নেই, বিভিন্ন সময়ে ওষুধের জোগান থাকে না।”
তবে, সম্পূর্ণ ছবিটিই যে নেতিবাচক, তা নয়। শিশুদের টীকা দেওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির অন্যতম। শিশুদের গুরুতর অসুস্থতার চিকিৎসার ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গ অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে। শিশুমৃত্যুর হারও এই রাজ্যে অনেক বেশি কমেছে।
কিন্তু তাতেও গোটা ছবিটা রাজ্যের পক্ষে ইতিবাচক নয়। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে গণস্বাস্থ্যের অর্থনীতি বিষয়ে গবেষক পৃথা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ভারতের অন্য অনেক রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক এবং সামাজিক সচেতনতা অনেক বেশি। ফলে, গণস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এই রাজ্যের এগিয়ে থাকার কথা ছিল। কেন তা হয়নি, খতিয়ে দেখা রাজ্য প্রশাসনের কর্তব্য।
অর্থনীতিবিদ সীমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা থেকে যে ছবিটা ফুটে উঠছে. তার একটা অন্য দিকও আছে। এই পরিসংখ্যান রাজ্য প্রশাসনকে দেখিয়ে দিচ্ছে, এখনও কোথায় কতখানি খামতি থেকে গিয়েছে। সেই ফাঁক পূরণ করার দায়িত্ব প্রশাসনের। তার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই।
পশ্চিমবঙ্গের ছবিটা বদলাবে কি? পরের স্বাস্থ্য সমীক্ষায় কি দেখা যাবে, রাজ্যের মানুষ আগের তুলনায় ভাল রয়েছেন? উত্তরের অপেক্ষায় থাকবে পশ্চিমবঙ্গ।