ভারতবাসীর চোখে জল, পেঁয়াজের ঝাঁঝে

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.08.27
Ind-onion ভারতে ফলন কম হওয়ায় পেঁয়াজের দাম বেড়েছে, প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। আগষ্ট,২০১৫
অনলাইন

ঠিক পেঁয়াজের ঝাঁঝে নয়, তার দামের ঝাঁঝে চোখে জল। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়তে আরম্ভ করল ভারতের বাজারে। কলকাতায় এখন এক কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে আশি থেকে পঁচাশি টাকায়। আতঙ্কে ভুগছেন ক্রেতারা, এই বুঝি একশো টাকা ছাড়িয়ে গেল এক কেজি পেঁয়াজের দাম। শুধু ভারতজুড়ে নয়, বাংলাদেশেও আঁচ লেগেছে পেঁয়াজের বাজারে। সেখানেও দর ৮০-৮৫-তে উঠেছে।

কলকাতার বেলেঘাটা অঞ্চলের বাসিন্দা গৌতম মোদক খানিক রসিকতার ঢঙেই বললেন, ‘আগে পকেট ভরে টাকা নিয়ে গেলে ব্যাগ ভর্তি পেঁয়াজ কেনা যেত, মশাই। এখন ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে গিয়ে পকেটভর্তি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে!’ এ দিকে, বাঙালি হেঁসেল পেঁয়াজ ছাড়া অচল। ফলে, এক মাসে প্রায় আড়াই গুণ দাম বাড়লেও বাঙালিকে পেঁয়াজ কিনতেই হচ্ছে।

কলকাতার অফিস পাড়া চাঁদনি চক অঞ্চলে রোলের দোকান চালান বিনয় সিং। মুখে জল আনা এগরোলের মধ্যে কাঁচা পেঁয়াজের উপস্থিতি একেবারে মাস্ট। বিনয় জানালেন, পেঁয়াজের দাম বাড়তে আরম্ভ করায় গোড়ায় অল্প পেঁয়াজের সঙ্গে অনেকটা শসা কুঁচির মিশেল দিয়ে সামলাতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু, খদ্দেররা সেই রোল খেতে একেবারেই রাজি নন। ফলে, পেঁয়াজে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। বিনয় বললেন, ‘দুম করে রোলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া মুশকিল, কিন্তু পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমুখী দামের চোটে লাভ একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।’

কেন পেঁয়াজের দাম এমন লাগামছাড়া হল? উত্তর কলকাতার দমদম পার্ক বাজারে আলু-পেঁয়াজের ব্যবসায়ী বাসুদেব দাস জানালেন, পাইকারিতেই পেঁয়াজ কেজিপ্রতি সত্তর টাকার বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। তার ওপর পাইকারি বাজার থেকে স্থানীয় বাজারে মাল নিয়ে আসারও খরচ আছে। ফলে, এর চেয়ে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। বাসুদেব বললেন, ‘আমাদেরও তো ক্ষতি হচ্ছে। লোকে পেঁয়াজের দাম শুনেই আঁতকে উঠছে। বড় জোর আড়াইশো কিনছে। আমাদেরই বা তেমন লাভ থাকছে কোথায়?’

বাসুদেবের দোকানের উল্টো দিকেই ফুলের ব্যবসায়ী তারাপদ মণ্ডলের দোকান। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘শুধু পেঁয়াজ? সব কিছুরই তো দাম আকাশছোঁয়া। আশি টাকা কেজি দরে পটল বিক্রি হচ্ছে,  পেঁপে পঞ্চাশ টাকা— মানুষ খাবেটা কী, বলতে পারেন?’


ফলন কম নাকি আড়তদারদের কারসাজি?

শুধু কলকাতা নয়, দেশের সর্বত্রই পেঁয়াজের দাম দ্বিগুণ-তিনগুণ হয়ে গিয়েছে। মহারাষ্ট্রের লাসলগাঁও-এ ভারতে পেঁয়াজের বৃহত্তম মাণ্ডি বা আড়ত। সেই বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে পঞ্চাশ টাকা কেজি দরে। এমন অস্বাভাবিক চড়া দাম কেন?  কৃষি-অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মার্চ থেকে জুন, যে সময়ে দেশের সিংহভাগ পেঁয়াজ চাষ হয়, তখন অস্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়াতেই ফসল উৎপাদন কমেছে। ফলে, বাজারে যোগান কম। তাই এমন অস্বাভাবিক দাম বেড়েছে।

দিল্লির অর্থনীতি গবেষণা কেন্দ্রের অর্থনীতিবিদ শাশ্বত চৌধুরী অবশ্য এই ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ মানতে নারাজ। তাঁর মতে,  ‘এই সমস্যার একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে পেঁয়াজের দালাল বা ফড়েরা। উৎপাদনের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম দেখেই তারা পেঁয়াজ মজুত করতে আরম্ভ করেছিল। তাতে বাজারে যোগান আরও কমেছে। এখন তারা অতি চড়া লাভে পেঁয়াজ বাজারে ছাড়ছে।’


দাম স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রের উদ্যোগ

তবে, কেন্দ্রীয় সরকার পেঁয়াজের দাম কমাতে উদ্যোগী হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৫০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল ঘোষণা করা হয়েছে। বেশি দামে কিনে ভর্তুকি দিয়ে কমদামে বিক্রির মাধ্যমে পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমুখী দাম সামাল দেওয়ার জন্য এই তহবিল থেকে রাজ্য সরকারগুলিকে অর্থসাহায্য করা হবে বলে জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই অন্ধ্র প্রদেশ ও তেলেঙ্গানা আর্থিক সাহায্য পেয়ে গিয়েছে। আরও সাতটি রাজ্য সাহায্যের জন্য আবেদন করেছে।

কেন্দ্রীয় খাদ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে,  এখন দেশে যত পেঁয়াজ মজুত আছে,  তাতে সেপ্টেম্বরের শেষ অবধি কোনও ঘাটতি হবে না। তার পর নতুন ফসল উঠবে। প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা হবে বলেও জানা গিয়েছে।

সরকারি তৎপরতার প্রভাব পড়েছে পেঁয়াজের বাজারেও। দাম এখনও তেমন না কমলেও আর বিশেষ বাড়ছেও না। কৃষি-অর্থনীতিবিদদের অনুমান,  আর সপ্তাহখানেকের মধ্যেই দাম কমতে আরম্ভ করবে।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর-এ পাবলিক পলিসির গবেষক শ্রিয়া মোহন মনে করিয়ে দিলেন, ‘পেঁয়াজের দামের সঙ্গে নির্বাচনের ফলাফলের সম্পর্ক ভারতে বেশ ঘনিষ্ঠ। ১৯৮০ সালে চরণ সিংহের সরকারের পতনের পিছনে একটা বড় কারণ ছিল পেঁয়াজের দাম। তার পরেও বহু নির্বাচনে পেঁয়াজের দামের প্রভাব পড়েছে। ফলে, বিহারের নির্বাচনের মুখে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজের দাম নিয়ে ঝুঁকি নিতে সরকার নারাজ।’

দাম কবে কমবে, জানা নেই। এখনও পেঁয়াজ বহুমূল্য পণ্য। পকেটে পড়া চাপকে হাসি-মস্করা দিয়ে ঢেকে রাখতে ব্যস্ত ভারতীয়রা। ইন্টারনেটে ঘুরছে হাজার রসিকতা। কেউ বিয়েতে মেয়েকে গয়নার বদলে পেঁয়াজ দেওয়ার কথা বলছেন,  কেউ আবার বলছেন, এক সঙ্গে দু’কেজি পেঁয়াজ কিনলে প্যান কার্ড দেখাতে হবে,  কারণ সেটা হাই ভ্যালু ট্রানজাকশন! কেউ আবার মাসিক কিস্তিতে পেঁয়াজ বিক্রি করার প্রস্তাবও দিচ্ছেন!


প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও

ভারতে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে রাজধানী সহ সারা দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম চড়ে যায়। এক সপ্তাহ আগেও যেখানে ৫০-৫৫ টাকা কেজি পেঁয়াজ মিলতো হঠাত ৮০-৯০ টাকায় উঠে যায়।

উল্লেখ্য, পেঁয়াজের উৎপাদন কম থাকায় বাংলাদেশ বরাবরই ভারত থেকে পেঁয়াজ আমাদানীর উপর নির্ভরশীল।

সিলেট থেকে প্রকাশিত সিলেট-টুডে কুলাউড়ার এক খবরে জানা গেছে, ৭২ ঘন্টার ব্যবধানে জেলার ৭ উপজেলায় কেজি প্রতি পেঁয়াজের ঝাঁঝ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। গত শুক্রবার পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম ছিল ৫০-৫৫ টাকা, বর্তমানে তা খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯০-১০০ টাকায়। পেঁয়াজের এমন ঝাঁঝে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

একুশে টিভি অনলাইন রিপোর্টে জানায়, সরবরাহ সংকটের চেয়ে হুজুগ ও গুজবেই পেঁয়াজের দাম বেশি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারক, আড়তদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা। চীন, মিসর ও পাকিস্তান থেকে প্রচুর পরিমানে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।

আমদানিকারকরা বলছেন, এরমধ্যে যে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে নতুন করে আর দাম বাড়ার কোন কারণ নেই। গত সোমবার সরকারও টিসিবির মাধ্যমে পেয়াজ আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ঢাকায় কারওয়ান বাজারে নিয়মিত বাজার করেন অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তা মনসুর আহমেদ। তিনি বেনারকে জানান, “গত সপ্তাহে আকষ্মিক পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমরা ক্রেতা সাধারন দিশাহারা হয়ে পড়ি। তবে আশার কথা যে ৯০ টাকায় উঠে যাবার পর এখন ২ দিন ধরে ৭০-৭৫ টাকায় নেমে এসেছে। আরো নামবে বলা হচ্ছে। নামলে হাফ ছেড়ে বাঁচবো”।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।