কলকাতার লি রোড এখন “সত্যজিৎ রায় ধরণী”

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.03.04
Ind-satyajit কলকাতার লি রোড এখন “সত্যজিৎ রায় ধরণী”।
অনলাইন

নামকরণ করতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর জুড়ি নেই। তাঁর শহরে মেট্রো রেলের স্টেশনের নাম মহানায়ক উত্তমকুমার, শহিদ ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্য সেন। জলের ট্যাঙ্কের নাম রামকৃষ্ণ পরমহংস, স্বামী বিবেকানন্দ, মাদার টেরেসা। এই বার লি রোডের নাম পাল্টে তিনি করে দিলেন সত্যজিৎ রায় ধরণী।

না, ভুল পড়েননি। সরণি নয়, ধরণী। অভিধান খুললে যে শব্দের অর্থের সঙ্গে রাস্তার বিন্দুমাত্র যোগ পাওয়া যাবে না। ধরণী মানে পৃথিবী। আর, রাস্তার নামের শেষে সচরাচর যে শব্দটি থাকে, সেই সরণির অর্থ রাস্তা।

এমন বিচিত্র নামকরণ কেন? কলকাতা পুরসভার এক অনুষ্ঠানে মেয়র ঘোষণা করলেন, মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছা অনুসারে দক্ষিণ কলকাতার লি রোডের নাম পাল্টে হচ্ছে সত্যজিৎ রায় সরণি। এই বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক তাঁর জীবনের অনেকখানি সময় কাটিয়েছিলেন লি রোডের কাছের রাস্তা বিশপ লেফ্রয় রোডে। কাজেই, সেই সুবাদে লি রোডের নাম পাল্টে তাঁর নামে করতেই পারে পুরসভা।

কিন্তু, মেয়রের ঘোষণার পরেই চমক। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, “সরণি অনেক হয়েছে, এই রাস্তার নাম থাক সত্যজিৎ রায় ধরণী।“ যেমন কথা, তেমন কাজ। মেয়র সঙ্গে সঙ্গেই ঘোষণা করে দিলেন, রাস্তার নাম হচ্ছে সত্যজিৎ রায় ধরণী!

এমন বিচিত্র নামকরণে অনেকেই অবাক। বিশিষ্ট ভাষাবিদ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য পবিত্র সরকার বললেন, “ধরণী দ্বিধা হও!” ইতিহাসবিদ শ্যামল সেনগুপ্ত বললেন, “এমন কাণ্ড কখনও শুনিনি। সরণির সঙ্গে ধরণীর অন্ত্যমিল আছে বটে, কিন্তু অর্থের কথা না ভেবে এমন নাম রাখা যায় নাকি?”

তবে, শহরের বহু বিশিষ্ট মানুষের মনেই একটা ক্ষীণ আশা ছিল, এই ঘোষণা সম্ভবত বাস্তবায়িত হবে না। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বুঝবেন, ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে, এবং তিনি নিজের ইচ্ছে ফিরিয়ে নেবেন। কিন্তু, সমস্ত আশায় জল ঢেলে কলকাতা পুরসভা লি রোড জুড়ে “সত্যজিৎ রায় ধরণী”-লেখা বোর্ড টাঙিয়ে দিল। অর্থাৎ, নামকরণের সিদ্ধান্তটি পাকা।

মেয়র অথবা মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছে হলেই কিন্তু শহরের রাস্তার নাম পাল্টানো যায় না। তার জন্য নির্দিষ্ট কমিটি আছে। কেন কোনও রাস্তার নাম পরিবর্তনের কথা ভাবা হচ্ছে, সেই কারণ দেখিয়ে কমিটির কাছে আবেদন করতে হয়। কমিটি প্রস্তাবটি বিবেচনা করে সম্মতি জানালে তবেই রাস্তার নাম বদলায়। লি রোডের ক্ষেত্রে কি সেই নিয়ম মানা হয়েছিল? পুরসভা সূত্রে খবর, না। কার্যত সে দিনের জনসভাতেই সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে যায়।

শহরবাসী কী বলছেন? কলকাতার এক বেসরকারি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্ত ঘোষ বললেন, মনীষীদের নামে রাস্তার নামকরণের ব্যাপারটা খুবই ভাল, সন্দেহ নেই। ছোট ছেলেমেয়েরা সেই মনীষীদের সঙ্গে প্রাথমিক ভাবে পরিচিত হতে পারবে এর মাধ্যমে। কিন্তু, সরণি আর ধরণী গুলিয়ে ফেলাটা বোধ হয় একটু হাস্যকর হল।

এক বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থার সহযোগী সম্পাদক অভিষেক সেনগুপ্ত একচোট হেসে বললেন, এটা পশ্চিমবঙ্গেই সম্ভব। এখানে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছের চেয়ে দামি আর কিছু নেই। তাতে বাঙলা ভাষা জাহান্নামে গেলে যাক।

এই তর্কে শহর জমজমাট। সপ্তাহের গোড়ায় মুখ্যমন্ত্রী যে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, সপ্তাহ ফুরনোর আগেই পুরসভা তা সফল করে দিল। এক সহনাগরিক বিষণ্ণ হেসে বললেন, শহরটাকে পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে অথবা বিভিন্ন নাগরিক পরিষেবা নিশ্চিত করতে যদি পুরসভা এতটাই তৎপর হত, তা হলে না হয় মেনেই নিতাম রাস্তার নাম ধরণী!

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।