শিল্প সম্মেলনে বিপুল লগ্নির প্রস্তাব এল পশ্চিমবঙ্গে

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.01.11
Ind-summit কলকাতায় অনুষ্ঠিত হলো ২ দিনের বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট।
অনলাইন

দু’দিনের সম্মেলন শেষে মোট আড়াই লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব। এ বার কি সত্যিই ঘুরে দাঁড়াবে শিল্প-রক্তাল্পতায় ভোগা পশ্চিমবঙ্গ?

গত শুক্র ও শনিবার কলকাতার ইকো পার্কে আয়োজিত বেঙ্গল গ্লোবাল বিজনেস সামিট-এর পর সরকারি আমলা থেকে রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ থেকে সাধারণ মানুষ, আশাবাদী অনেকেই। এবং, বিনিয়োগের প্রশ্নে যাঁরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সেই বিনিয়োগকারীরাও বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ সম্বন্ধে ইতিবাচক ভাবনা নিয়েই ফিরছেন তাঁরা।

মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, সম্মেলনে অন্তত ২,৫০,১০৪ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব রাজ্যের শিল্প মন্ত্রক সূত্রে হিসেব পাওয়া গেল, এর মধ্যে ১,১৭,১০৭ কোটি টাকা উৎপাদন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করা হবে, খনিতে লগ্নির প্রস্তাব ২৩,৩০০ কোটি টাকার। এ ছাড়াও বিদ্যুৎ ও পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তিতে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ৮,৪৬২ কোটি টাকা, পরিবহণে ৯,৩৮৪ কোটি টাকা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে ২৩০ কোটি টাকা, তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকমে ৮৬৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে। নগরোন্নয়নে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ ২৯,০০০ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ৫০,০০০ কোটি টাকা।

গত বছরের শিল্প সম্মেলনের শেষেও রাজ্য সরকার দাবি করেছিল, মোট ২,৪৩,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু, তার সঙ্গে এ বছরের ফারাক হল, গত বছরের প্রস্তাবিত বিনিয়োগের সিংহভাগই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের বিনিয়োগ, এবং অনেকগুল বিনিয়োগ প্রস্তাবই আসলে দীর্ঘমেয়াদি অথবা পুরনো প্রতিশ্রুতি। এ বছরের আড়াই লক্ষ কোটি টাকার প্রস্তাবের সম্পূর্ণটিই এসেছে বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে। ফলে, মুখ্যমন্ত্রীর আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

শিল্পপতিদের বক্তব্যেও উৎসাহিত হতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের সর্ববৃহৎ শিল্পপতি রিলায়েন্স-এর অধিকর্তা মুকেশ অম্বানি বললেন, “গত তিন বছরে আমরা পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। আমি অন্যদের এই রাজ্যে বিনিয়োগ করতে সুপারিশ করছি।” হিরানন্দানি গ্রুপের অধিকর্তা নিরঞ্জন হিরানন্দানি বললেন, “আগে বিনিয়োগকারীরা এই রাজ্যে আসতে ভয় পেতেন। এখন পশ্চিমবঙ্গেই সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ পাওয়া যায়।” উপস্থিত ছিলেন সজ্জন জিন্দল, পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিনিয়োগকারীরাও।

মমতা বললেন, “বিনিয়োগকারীরা এই রাজ্যে এলে রাজ্য সরকার তাঁদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে। জমি পেতে কোনও সমস্যা হবে না। রাজ্যের ল্যান্ড ব্যাঙ্কে পাঁচ হাজার একর জমি রয়েছে।” প্রসঙ্গত, জমি অধিগ্রহণ করতে মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তিকেই রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনার সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করেন ওয়াকিবহাল মহল।

যে কোনও সমস্যায় যে তিনিই শিল্পপতিদের সহায় হবেন, তা-ও স্পষ্ট করে বলে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। “আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতাই আমাদের দায়বদ্ধতা।... যদি সমস্যা হয়, আমার কাছে আসুন। এক সেকেন্ডে সমাধান করে দেব,” বললেন মুখ্যমন্ত্রী। শিল্প সম্মেলনের দিন দুয়েক আগে শালবনিতে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বিনিয়োগকারীদের কাছে কাজ চেয়ে অথবা কাঁচামাল সরবরাহের বরাত চেয়ে অশান্তি পাকালে চলবে না। তিনি যে সিন্ডিকেট-রাজ সহ্য করবেন না, তাও জানিয়েছিলেন সে দিনই।

রাজ্যের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যদিও শিল্প সম্মেলনের এই সাফল্যকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী বললেন, “শিল্পের দেখা নেই। শিল্পের জন্য যে মৌলিক বিষয়গুলির প্রয়োজন, যেমন জমি বা শিল্পবান্ধব পরিবেশ, তার কোনওটাই নেই। শিল্প আকাশে-পাতালে হয় না। নির্বাচনের আগে শিল্প সম্মেলনের নামে রাজনৈতিক নেতাদের ডেকে ধাপ্পা দিচ্ছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।” বামফ্রন্টের বিমান বসুও বললেন, সম্মেলনে এমন কোনও প্রাপ্তি নেই যাকে রাজ্য সরকার সাফল্য বলে দাবি করতে পারে।

তবে, তাঁদের সঙ্গে একমত হচ্ছেন না অর্থনীতিবিদ সীমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন, “মুখ্যমন্ত্রী এত দিনে শিল্পের গুরুত্ব বুঝেছেন। তাঁর কথায় স্পষ্ট, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, এখন শিল্প তৈরি না হলে পশ্চিমবঙ্গের বাঁচার আশা নেই। ফলে, এই বার তিনি প্রশ্নটিকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দেবেন। শিল্পমহলের হাবভাবও যথেষ্ট আশাব্যাঞ্জক।”

আশাবাদী রাজ্যের মানুষও। কলেজছাত্র সোহম সরকার বললেন, “এত দিন সবাই জানত, লেখাপড়া শেষ হলেই হয় বেঙ্গালুরু নয় দিল্লি-মুম্বইয়ে পাড়ি জমাতে হবে। পশ্চিমবঙ্গে শিল্প তৈরি হলে আমরা এখানেই চাকরি পাব। এ বছরের সম্মেলনের খবর পড়ে মনে হচ্ছে, হয়তো সত্যিই শিল্প হবে।” সাম্প্রতিক পশ্চিমবঙ্গে এই আশাবাদ রীতিমত ব্যতিক্রমী।

আরও এক দিক থেকে ব্যতিক্রমী এই শিল্প সম্মেলন। শুধু শিল্পপতি অথবা দেশের নেতা-মন্ত্রীরাই নন, উপস্থিত ছিলেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং টবগে, বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও ব্রিটেনের কর্মসংস্থান মন্ত্রী প্রীতি পটেল। আশা জাগছে, হয়তো এই সম্মেলন থেকেই তৈরি হবে পূর্ব ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নতুন শিল্প-সম্পর্ক। শিল্পের সুতোয় বাঁধা পড়বে দুই বাংলা।

দুই দিনের বাণিজ্য সম্মেলন থেকে এই আশাগুলোই প্রাপ্তি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।