ঝুঁকি মাথায় নিয়েই বেঁচে আছে সুন্দরবন
2015.12.17
‘কোথাও আর যাওয়ার জায়গা নেই, তাই এখানেই থাকি।’
সুন্দরবনের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বাঁধের ওপর ঘর তৈরি করে বাস করছেন যাঁরা, জোয়ারের জল ফুলেফেঁপে উঠলে যাঁদের সর্বস্ব চলে যেতে পারে নদীর গর্ভে, তেমন কোনও পরিবারকে যদি প্রশ্ন করেন, কেন তাঁরা এই বিপুল ঝুঁকি মাথায় নিয়েও এ ভাবে বাস করছেন, এই উত্তরটাই পাবেন।
উত্তর যিনি দেবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি বয়স্কা মহিলা। কারণ, বাড়ির পুরুষরা একে একে চলে গিয়েছে কলকাতায়, অথবা ভারতের অন্য কোনও প্রান্তের অন্য কোনও শহরে। কাজের খোঁজে। কমবয়সী মেয়েরাও লোকের বাড়িতে থাকা-খাওয়ার কাজ নিয়ে চলে গিয়েছে। কে বলতে পারে, হয়তো পাচার হয়ে হারিয়ে গিয়েছে দিল্লি-মুম্বইয়ের নিষিদ্ধ পল্লির অন্ধকারে। গ্রামে থেকে গিয়েছেন শুধু বয়স্কা মহিলারা। আর আছে শিশুরা।
২০০৯ সালের আয়লা বদলে দিয়ে গিয়েছে সুন্দরবনের জীবনযাত্রার ছবিটাই। প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থান থেকে খাদ্যের পরিমাণ, সব কিছুর ওপরই। বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট জানাচ্ছে, সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের গড়পড়তা দৈনিক আয় পঁয়ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ টাকার মধ্যে, যার তুলনা পৃথিবীতে মেলা ভার। চাষবাস, মাছ ধরা বা কাঠ কিংবা মধু সংগ্রহের মতো চিরাচরিত জীবিকা আঁকড়ে কোনও ক্রমে বেঁচে থাকার কোনও বিকল্প সেখানে বহু মানুষের নেই।
ভারত আর বাংলাদেশ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অঞ্চল। মোট ২৫,০০০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই অঞ্চলের প্রায় চল্লিশ শতাংশ, ৯৬৩০ বর্গ কিলোমিটার ভারতের অন্তর্গত, বাকিটা বাংলাদেশের। ভারতীয় সুন্দরবনের ১০২টি দ্বীপে বাস করেন প্রায় ৪৫ লক্ষ মানুষ। বাংলাদেশি সুন্দরবনের জনসংখ্যা ৭৫ লক্ষের কাছাকাছি। সব মিলিয়ে, সুন্দরবনই দুনিয়ার সবচেয়ে জনবহুল ‘দ্বীপ’ অঞ্চল, যদিও একে আক্ষরিক অর্থে দ্বীপ বলা চলে না।
আয়লা ঘুর্নিঝড় কতখানি বদলে দিয়েছে সুন্দরবনের ছবিটা? সন্দেশখালি অঞ্চলের বাসিন্দা মোফিদা বিবি বললেন, ‘তখন যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তার ধাক্কা তো আছেই। যেটা তার চেয়েও বড় ধাক্কা, আয়লার ফলে বহু মানুষের যৎসামান্য যে সম্পদটুকু ছিল, তা-ও নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এখন আর রোজগারের কোনও পথই নেই। চোখের সামনে কতগুলো পরিবার সম্পূর্ণ পথে বসল, গুনে শেষ করতে পারব না।’
আয়লার ধাক্কাটা বড়। কিন্তু, প্রতি দিন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তৈরি হওয়া বিপদ গ্রাস করছে সুন্দরবনকে। এই অঞ্চলে নদীর জলস্তর বাড়ছে বছরে গড়ে ৮ মিলিমিটার। দুনিয়ার যে দ্বীপরাষ্ট্রগুলিকে ‘সর্বাধিক বিপন্ন’ তকমা দিয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জের ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ, সেখানে জলস্তর বৃদ্ধির হার বছরে পাঁচ মিলিমিটারের কাছাকাছি। সুন্দরবন প্রকৃত অর্থে দ্বীপ নয়, তাই ‘সর্বাধিক বিপন্ন’ দ্বীপের তালিকায় তার নামও নেই। কিন্তু, শুধু জলস্তর বৃদ্ধির হিসেবেই টুভালু বা মালদ্বীপের চেয়ে অনেক বেশি বিপন্ন সুন্দরবন।
তার বিপদের তালিকা অবশ্য এখানেই শেষ নয়। নব্য দ্বীপ হওয়ার ফলে সুন্দরবনের মাটি বসে যাচ্ছে বছরে গড়ে ৪ মিলিমিটার। অর্থাত্ কার্যত জলের স্তর বাড়ছে বছরে ১২ মিলিমিটার হারে। আশ্চর্য নয় যে, গত চার দশকে সুন্দরবন থেকে কলকাতা শহরের চেয়েও বড় মাপের এক ভূখণ্ড নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। শুধু গত দশকেই হারিয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের মাপ প্রায় ৪৫ বর্গ কিলোমিটার।
আগামী এক দশকে আরও ২৫০ বর্গ কিলোমিটার জমি জলের তলায় চলে যাবে। এই জমিতে এক কালে ধান উৎপন্ন হত। ফলে, অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বিপুল। বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসেব বলছে, জলস্তর বৃদ্ধি, সাইক্লোন এবং অন্যান্য জলবায়ু সংক্রান্ত বিপদের ফলে ভারতীয় সুন্দরবন অঞ্চলে প্রতি বছর প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। সেই ক্ষতির বড় অংশ বহন করছেন সুন্দরবনের হতদরিদ্র মানুষরাই।
শুধু জলস্তর বৃদ্ধিই নয়, জলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিও বিপন্ন করছে সুন্দরবনের মানুষকে, বললে কলকাতার সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের অধিকর্তা আশিস ঘোষ। তাঁর মতে, ‘ভারতীয় সুন্দরবনের ৪৫ লক্ষ মানুষকেই দুনিয়ার বিপন্নতম জনগোষ্ঠীর তালিকাভুক্ত করা যায়, এবং করা উচিত।’ বাংলাদেশের সুন্দরবনেও ছবিটা অবিকল এক রকম।
কতটা খারাপ আছেন সুন্দরবনের মানুষরা? কয়েকটা পরিসংখ্যান পেশ করা যাক। অঞ্চলের ৫০ শতাংশ মানুষ বাস করেন দারিদ্রসীমার নীচে। সিংহভাগ শিশু অপুষ্টির শিকার। ৭০ শতাংশ বাড়িতে এখনও পরিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই, মাত্র ১৭ শতাংশ বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছেছে। পরিবেশ সংক্রান্ত কারণে প্রতি বছর প্রায় চার হাজার মানুষ অকালে মারা যান, অসুস্থ হন প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষ। মহিলা আর শিশুরাই বেশি অসুস্থ থাকেন।
আশিস ঘোষ বললেন, ‘আমার পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কোনও আশার কথা শোনানোর উপায় নেই। ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবন থেকে দশ লক্ষেরও বেশি মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে হবে। আমরা কি সেই বিপুল উদ্বাস্তু স্রোতের জন্য তৈরি? কোথায় যাবেন এই মানুষরা? তাঁদের জীবিকার কী হবে? এখনও আমাদের কাছে এই প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই। কিন্তু, সময় দ্রুত কমে আসছে।’
পশ্চিমবঙ্গ সরকার কি যথেষ্ট চেষ্টা করছে? সুন্দরবন অঞ্চলের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মী আবু বকর লস্কর বললেন, না। সুন্দরবনের জন্য বাজেটে যত টাকা বরাদ্দ হচ্ছে, তার ৭৫ শতাংশও শেষ অবধি খরচ হচ্ছে না।
পরিবেশবিদ জয়ন্ত বসু বললেন, ‘এখন অবধি বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে যেটুকু গলার আওয়াজ তুলেছে, ভারত তার তুলনায় প্রায় কিছুই করেনি। তার কারণ, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কোণে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে থাকা দরিদ্র অঞ্চলটি নিয়ে বাকি দেশের, বিশেষ করে রাজনীতিক এবং সরকারি আধিকারিকদের বিশেষ হেলদোল নেই। কিন্তু সুন্দরবনের অধিবাসী এবং জৈববৈচিত্রকে বাঁচাতে হলে এই পরিস্থিতি বদলাতে হবে। দুই প্রতিবেশী দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকেও সুন্দরবনের স্বার্থে গলা তুলতে হবে।’
যত দিনে সচেতনতা তৈরি হবে, তত দিনে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে না তো? আশঙ্কায় প্রহর গুনছেন সুন্দরবনের বিপন্ন বাসিন্দারা।