‘রসগোল্লা’র আবিষ্কার নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িশ্যার মধ্যে লড়াই চলছে

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.09.24
Ind-sweet পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িশ্যার মধ্যে রসগোল্লার মালিকানা নিয়ে চলছে লড়াই। সেপ্টেম্বর,২০১৫
অনলাইন

দুই পড়শির মধ্যে তিক্ত লড়াই। আর তা কি না মিষ্টির রাজা রসগোল্লাকে নিয়ে!

প্রায় তিন মাস ধরে পশ্চিমবঙ্গ আর উড়িশ্যার মধ্যে প্রবল যুদ্ধ চলছে। সম্প্রতি দেশব্যাপী এক সমীক্ষায় যে মিষ্টিটি জাতীয় মিষ্টির সম্মান পেয়েছে, সেই রসগোল্লা সৃষ্টি হয়েছিল কোন রাজ্যে, লড়াই তা নিয়েই। যুদ্ধের দামামা প্রথম বাজিয়েছিল উড়িশ্যাই। দাবি করেছিল, গোটা দুনিয়া যে মিষ্টিকে কলকাতার সঙ্গে এক এবং অভিন্ন হিসেবে দেখে, সেই রসগোল্লার উৎপত্তি নাকি ভুবনেশ্বর ও কটকের মধ্যবর্তী পহলা অঞ্চলে, এবং অন্তত ৩০০ বছর আগে। এই মিষ্টান্নের ওপর জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়াও আরম্ভ করে নবীন পট্টনায়কের সরকার।

জিওগ্রাফিকাল ইন্ডিকেশন বা জিআই রেজিস্ট্রেশনের অর্থ হল, কোনও একটি বিশেষ পণ্যের ওপর কোনও অঞ্চলের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া। জিআই রেজিস্ট্রেশন তখনই দেওয়া হয়, যখন প্রমাণিত হয় যে সেই নির্দিষ্ট পণ্যটি কোনও একটি বিশেষ অঞ্চলেই আবিষ্কৃত হয়েছে বা তৈরি হয়, এবং তা তৈরি করার সময় কিছু সনাতন পদ্ধতি মেনে চলা হয়, তার একটি নির্দিষ্ট গুণমান আছে। জিআই রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পর চাইলে পেটেন্টের জন্যও আবেদন করা যেতে পারে।

অন্য এক মহলের দাবি, সেই দ্বাদশ শতাব্দী থেকেই পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে রসগোল্লা ভোগ প্রচলিত। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, প্রতি বছর রথযাত্রার দিন লক্ষ্মীর মানভঞ্জন করতে জগন্নাথ তাঁকে রসগোল্লা খাওয়ান।

এই জোড়া দাবির জোরে যখন রসগোল্লা আবিষ্কারের কৃতিত্ব দখল করে নিচ্ছি উড়িশ্যা, তখনই মাঠে নামে পশ্চিমবঙ্গও। ‘পশ্চিমবঙ্গ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতি’-র মুখপাত্র জগন্নাথ ঘোষ জানালেন, যাতে উড়িশ্যার হাতে রসগোল্লার অধিকার না চলে যায়, তা নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দাবিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, রসগোল্লার আবিষ্কর্তা হিসেবে বাংলা যাতে তার ঐতিহাসিক স্বীকৃতি বজায় রাখতে পারে, তার জন্য সব রকম ব্যবস্থা করতে হবে।


চলছে ইতিহাস ঘাটাঘাটি

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পাওয়ার পরই খেলা ধরে নেয় পশ্চিমবঙ্গ সরকার। খাদ্য-ঐতিহাসিক হরিপদ ভৌমিককে দায়িত্ব দেয়, রসগোল্লার ওপর পশ্চিমবঙ্গের দাবির ঐতিহাসিক প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। হরিপদ ভৌমিকের দীর্ঘ দিনের গবেষণা রসগোল্লা নিয়েই। তিনি বললেন, “ উড়িশ্যার দাবি যে পহলা রসগোল্লা নিয়ে, সেটা আসলে রসগোল্লাই নয়। সেটা ক্ষীরমোহন। রসগোল্লা হতে হলে সেটা ছানার হতেই হবে। এবং, তার সৃষ্টিকর্তা কলকাতার নবীনচন্দ্র দাস। ১৮৬৮ সালে রসগোল্লার জন্ম।”

ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি জিআই রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করল পশ্চিমবঙ্গ। শুধু তাই নয়, চেন্নাইয়ের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-এর কার্যালয়ে আবেদন করেছে, যেন তারা এই বিবাদের মধ্যস্থতা করে। পিছিয়ে নেই উড়িশ্যাও। রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের অধীনে তিনটি কমিটি তৈরি করেছে সরকার। প্রথম কমিটির কাজ, রসগোল্লা বিষয়ে সমস্ত ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে বের করা। দ্বিতীয় কমিটি রসগোল্লার ওপর পশ্চিমবঙ্গের দাবির যাথার্থ্য খতিয়ে দেখবে, আর তৃতীয় কমিটি উড়িশ্যার দাবিগুলিকে সাজাবে।

মিষ্টি নিয়ে এই তুমুল যুদ্ধে খানিক হতবাক সৌমিক দাশগুপ্ত। পেশায় ইঞ্জিনিয়র সৌমিক জন্মসূত্রে বাঙালি, কিন্তু দীর্ঘ দিন কটকের বাসিন্দা। নিজেকে উড়িয়া বলেই দাবি করেন এই খাদ্যরসিক। বললেন, এটা অবান্তর তর্ক। আমি পহলা রসগোল্লাও খেয়েছি, আর কলকাতার রসগোল্লাও খেয়েছি। দুটো দুই গোত্রের মিষ্টি। এ বার, কোনটাকে আসল রসগোল্লা বলবেন? আমার মত হল, আসল-নকল নিয়ে মাথা ঘামানোরই দরকার নেই। আর দুটো গরম-গরম রসগোল্লা খান বরং।

এমন মধুরেণ সমাপয়েৎ-এ অবশ্য রুচি নেই নবীনচন্দ্র দাসের বংশধরদের। তাঁরা কলকাতার খ্যাতনামা মিষ্টির দোকান কে সি দাস অ্যান্ড কম্পানির মালিক। নবীনচন্দ্রের বংশের পঞ্চম প্রজন্মের প্রতিনিধি সঞ্জয় দাস জানালেন, তাঁদের কাছে সমস্ত নথি রয়েছে যাতে প্রমাণ করা সম্ভব যে রসগোল্লা কলকাতাতেই তৈরি। সঞ্জয় জানালেন, জিআই রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেলে রসগোল্লা নিয়ে অনেক বেশি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সম্ভব। এই লড়াই জিততে যত দূর যেতে হয়, তারা যেতে তৈরি।

কলকাতায় গত শতাব্দীর গোড়ায় তৈরি হয়েছিল রসগোল্লা ভবন। সেই বাড়ির মালিক দাসরাই। তাঁরা জানালেন, সেখানে একটি রসগোল্লা জাদুঘর তৈরি করার কথাও ভাবছেন তাঁরা।

কে জিতবে?

কে জিততে চলেছে এই লড়াইয়ে? বিশিষ্ট উড়িয়া সাংবাদিক যযাতি করণ বললেন, যদিও উড়িশ্যা গোড়ায় অনেকটা এগিয়ে ছিল, এখন কিন্তু অ্যাডভান্টেজ পশ্চিমবঙ্গের। কারণ, পহলা রসগোল্লার ইতিহাস যে সত্তর-আশি বছরের পুরনো নয়, সেটা খুব সহজেই প্রমাণ হয়ে যাবে। এই লড়াইয়ে জিততে হলে বরং জগন্নাথ মন্দিরে রসগোল্লার প্রচলনের প্রসঙ্গটাকেই গুরুত্ব দিতে হবে।

উড়িশ্যার বাণিজ্য মন্ত্রকের এক মুখপাত্র বললেন, মন্দিরে রসগোল্লার প্রচলন বিষয়ক প্রামাণ্য নথি আমাদের কাছে নেই। ফলে, সে পথে হাঁটা মুশকিল। ইতিহাসবিদ হরিপদ ভৌমিক অবশ্য প্রসঙ্গটাই উড়িয়ে দিচ্ছেন। বলছেন, তিনশো বছর আগে জগন্নাথ মন্দিরে ছানার তৈরি কোনও মিষ্টান্ন ভোগ হিসেবে দেওয়াই যেত না।

তা হলে কি পশ্চিমবঙ্গই জিতছে? দিল্লির অর্থনীতি গবেষণা সংস্থা টেরি-র অর্থনীতিবিদ শাশ্বত চৌধুরী বললেন, হয়তো পশ্চিমবঙ্গই স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু, তাতে কী লাভ? যে পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি হয়, তার ক্ষেত্রেই জিআই রেজিস্ট্রেশন গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, দার্জিলিং চা। রসগোল্লার বাজার তো একেবারেই স্থানীয়। ভবিষ্যতেও যে রফতানি খুব বাড়বে, সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। তার ওপর, এই বাজার একেবারেই অসংগঠিত। এখানে জিআই রেজিস্ট্রেশন দিয়ে কী হবে?

সমাজতত্ত্ববিদ অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বললেন, সম্ভবত রাজনীতিকরা খুব সচেতন ভাবে খেলাটাকে প্রাদেশিক খণ্ড জাতীয়তাবাদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। যে প্রশ্নটা নিতান্তই টেকনিকাল, তাকে নিজের নিজের রাজ্যের সম্মানের লড়াইয়ে পরিণত করেছেন। কোন রাজ্য রসগোল্লার জিআই রেজিস্ট্রেশন পেল, তাতে সাধারণ মানুষের কিচ্ছু এসে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু, আমরা সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়লাম এই যুদ্ধ দেখে! এ ভাবেই রাজনীতিকরা খেলেন, আর আমরা সেই খেলা দেখি।

যা-ই হোক না কেন, রসগোল্লা নিয়ে উত্তেজনার পারদ এখনও ঊর্ধ্বমুখী। লড়াই এখনই থামার নয়।

লড়াইয়ের শেষে দুই প্রতিবেশী রাজ্য রসগোল্লা দিয়েই মিষ্টিমুখ সেরে ফের বন্ধু হবে তো?

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।