সেপ্টেম্বর মাসে সন্ত হবেন মাদার টেরেসা

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.03.16
Ind-teresa সেপ্টেম্বর মাসে সন্ত হবেন মাদার টেরেসা। ১৯৮৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে পোপ জন পল (২য়) কলকাতা সফরকালে মাদার টেরেসার সঙ্গে তোলা ছবি।
এএফপি

মাদার টেরেসার নাম মুছে যাবে কলকাতা থেকে!

অতঃপর আর ‘মাদার’ নন, তাঁর পরিচিতি হবে সেন্ট বা সন্ত টেরেসা। পোপ ফ্রান্সিস সিদ্ধান্ত করেছেন, আগামী ৪ সেপ্টেম্বর মাদারের ক্যাননাইজেশন হবে, তিনি রোমান ক্যাথলিক চার্চের সন্ত হিসেবে গণ্য হবেন।

সন্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার আবশ্যিক শর্ত, অন্তত দুটি মিরাকল বা চমৎকার ঘটাতে হবে। এমন ঘটনা, বিজ্ঞানে যার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। ১৯৯৭ সালে মাদারের মৃত্যুর পর ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বাসিন্দা মণিকা বেসরা নামক এক মহিলা জানান, তিনি পেটের অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগছিলেন। মাদারের ছবি দেওয়া একটি লকেট তাঁকে পরতে দেওয়া হয়। মণিকার দাবি, সেই লকেট থেকে নিঃসৃত হয়েছিল এক অপার্থিব আলোকরশ্মি। সেই আলো তাঁর পেটে প্রবেশ করে, এবং যাবতীয় যন্ত্রণার উপশম হয়। ভ্যাটিক্যান জানায়, এই ঘটনাটিকে চমৎকার ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় চমৎকারটিকেও স্বীকৃতি দেন পোপ ফ্রান্সিস। ২০০৮ সালে ব্রাজিলের এক যুবক মস্তিষ্কে জীবাণু সংক্রমণে ভুগছিলেন, এবং জটিল অস্ত্রোপচার ছাড়া বাঁচার রাস্তা ছিল না। তাঁর স্ত্রী এক প্যারিশ চার্চে মাদারের কাছে স্বামীর সুস্থতা প্রার্থনা করেন। এবং, তার পরই কোনও অস্ত্রোপচার ছাড়াই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান সেই যুবক।

বর্তমানে বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা দম্পতি অভিজয় ও মৌপিয়া নন্দীকে (অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত) অবশ্য মাদারের চমৎকারের জন্য এত দূরে তাকাতে হয় না। পেশায় তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী অভিজয় বললেন, তাঁদের জীবনটাই বদলে গিয়েছে মাদারের জন্য। বিয়ের সাত বছর পরেও তাঁরা সন্তানহীন ছিলেন। চিকিৎসকরা জানিয়ে দিয়েছিলেন, সন্তানলাভের আশা নেই। অভিজয়রা তখন দ্বারস্থ হন মিশনারিজ অব চ্যারিটির। কলকাতায় মাদারের প্রতিষ্ঠিত এই সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে আরও অনেক সন্তানহীন দম্পতির মতো তাঁরাও দত্তক নেন একটি পুত্রসন্তান। সেই অনুপমই অভিজয় আর মৌপিয়ার জীবনে মাদারের চমৎকার।

অভিজয় বললেন, ভারতে দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রচুর দুষ্টচক্র কাজ করে। সেখানে মাদারের তৈরি মিশনারিজ অব চ্যারিটি যেন স্বয়ং ঈশ্বরের আশীর্বাদ। দত্তক দেওয়ার সময় তাঁরা শুধু যাচাই করে নেন, শিশুটিকে প্রকৃত মা-বাবার ভালবাসা দেওয়ার ক্ষমতা আছে কি না দম্পতির। মাদারের সন্ত হওয়ায় কেমন লাগছে, সেই প্রশ্নের উত্তরে অভিজয় বললেন, “আমাদের কাছে তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি। সব সন্তের সেরা সন্ত। তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর ভাষা আমাদের নেই।” ৪ সেপ্টেম্বর তাঁরা কোনও একটি ক্যাথলিক চার্চে প্রার্থনা করতে যাবেন বলে জানালেন অভিজয় ও মৌপিয়া। উল্লেখ্য, তাঁরা দুজনেই কিন্তু ধর্মে হিন্দু।

খুশির হাওয়া মিশনারিজ অব চ্যারিটিতেও। প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র সুনীতা কুমার জানালেন, তাঁরা অত্যন্ত আনন্দিত। প্রতিষ্ঠানের সিস্টাররা মাদারের সন্ত হওয়ার খবর পেয়ে একটি বিশেষ প্রার্থনাসভার আয়োজন করেন। এক সিস্টার বললেন, “প্রার্থনার মাধ্যমেই আমরা আনন্দ পাই। আমাদের খুশির প্রকাশও প্রার্থনার মাধ্যমেই হয়।”

মাদারের সন্ত হওয়া অবশ্য শুধু সময়েরই অপেক্ষা ছিল। ২০০৩ সালে তাঁর বিটিফিকেশন হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় চমৎকারটিকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময়ই পোপ ফ্রান্সিস জানিয়ে দেন, মাদারকে সন্ত হিসেবে ঘোষণা করবে চার্চ। কবে, শুধু সেটুকুই প্রশ্ন ছিল। ২০১৬ সালে তা হওয়ার একটি বিশেষ তাৎপর্য দেখছেন কলকাতার আর্চবিশপ টমাস ডিসুজা। বললেন, ক্যাথলিক চার্চ এই বছরটিকে জুবিলি ইয়ার অব মার্সি হিসেবে বিবেচনা করছে। এই বছর মাদার সন্ত হলেন, এটা ভাল খবর।

১৯১০ সালের ২৬ অগস্ট তৎকালীন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ম্যাকাডোনিয়ায় এক অ্যালবেনিয় রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্ম মাদারের।
১৯২৮ সালে তিনি সিস্টার্স অব লোরেটো-তে যোগ দেন এবং তার পরের বছর ভারতে পৌঁছোন। প্রথমে দার্জিলিং-এ লরোটো কনভেন্টে শিক্ষিকা হিসেবে কাজ শুরু করেন। কলকাতাতেও আসেন সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষিকা হিসেবেই। ১৯৫০ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মিশনারিজ অব চ্যারিটি।

তত দিনে তাঁর পোশাক হয়েছে সাদা শাড়ি, তার নীল রঙের পাড়। মাদারকে গোটা দুনিয়া চেনে এই পোশাকেই। মাদারের পরিধেয় বলেই ভারতে সেবার রঙও সাদা-নীল। ‘দরিদ্রদের মধ্যেও দরিদ্রতম’ জন্য কাজ করাকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেন মাদার। ১৯৭৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান তিনি, ১৯৮০ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন। ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন তিনি।

ইতিহাসবিদ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা পত্রলেখা বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, “সন্ত হওয়ার ব্যাপারটা ক্যালথিক চার্চের নিয়ম মেনে ঘটেছে। কিন্তু মানবসেবা যদি ধর্ম হয়, তাতে মাদার টেরেসার কোনও তুলনা মেলা অসম্ভব। কলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকা অনাথ, আতুরদের জন্য তিনি যে সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, তা অকল্পনীয়। যে কুষ্ঠ রোগীরা সমাজে সম্পূর্ণ ব্রাত্য, অনাকাঙ্ক্ষিত, মাদার তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। মানবতার ইতিহাসে তিনি এক বিরল চরিত্র।”

কলকাতার যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন মাদার, এন্টালির সেই লোরেটো কনভেন্টের প্রাক্তন ছাত্রী দেবলীনা ভট্টাচার্য বললেন, “আমাদের ছাত্রজীবনে শিক্ষিকারা বার বার মাদারের উদাহরণ দিতেন। বলতেন, সেবাই শ্রেষ্ঠ মানবধর্ম এবং সেই ধর্মের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তপস্বিনী মাদার। আমার মনে হয়, মাদারের সন্ত হওয়ার ঘটনাটিকে যদি উদযাপন করতেই হয়, তবে ফেসবুকে স্টেটাস আপডেট দিয়ে নয়, কোনও ভাবে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েই তা করা উচিত। মাদারকে শ্রদ্ধা জানাতে হলে মাদারের দেখানো পথেই তা করা ভাল।”

মাদারের ক্যাননাইজেশন অনুষ্ঠান আয়োজিত হবে রোমে। আর্চবিশপ টমাস ডিসুজা এবং মিশনারিজ অব চ্যারিটির সুপিরিয়র জেনারেল সিস্টার প্রেমা সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। অক্টোবর মাসে কলকাতার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে একটি বিশেষ থ্যাঙ্কসগিভিং মাস আয়োজন করার কথা চলছে।







মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।