স্টিং অপারেশন, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা জড়ালেন দুর্নীতির অভিযোগে
2016.03.14
বিধানসভা নির্বাচনের আর এক মাসও বাকি নেই। এই সময় অপ্রত্যাশিত ঝড়ে টালমাটাল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি।
সোমবার সকালে স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হল একটি ভিডিও। একটি স্টিং অপারেশনের ভিডিও। দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ, মন্ত্রী, নেতারা ঘুষ নিচ্ছেন অকাতরে। চার লক্ষ, পাঁচ লক্ষ টাকা। এক নেতার ক্ষেত্রে কুড়ি লক্ষ টাকাও। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই প্রথম এমন স্টিং অপারেশন।
নাম জড়িয়েছে যাঁদের, তাঁরা প্রত্যেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। তালিকায় আছেন মুকুল রায়, যিনি প্রায় এক বছরের বিচ্ছেদ কাটিয়ে ফের ঘনিষ্ঠ হয়েছেন রাজ্যের শাসক দলের। আছেন রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সৌগত রায়, সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার, দলের অন্যতম সংখ্যালঘু মুখ সুলতান আহমেদ, কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং প্রাক্তন মন্ত্রী, বর্তমানে সারদা কাণ্ডে বিচারাধীন কারাবন্দি মদন মিত্র। নাম জড়িয়েছে পুলিশকর্তা সৈয়দ মহম্মদ হুসেন মির্জা-রও।
ঘটনার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে নারদ নিউজ ডট কম নামে একটি সংবাদ ওয়েবসাইট। কার্যত আগে কখনও নামই শোনা যায়নি এই সংবাদ সংস্থার।
স্টিং অপারেশনটির দায়িত্বে ছিলেন যিনি, সেই ম্যাথু স্যামুয়েলস অবশ্য স্টিং অপারেশনের জন্য বেশ খ্যাতনামা। ২০০১ সালে তিনিই ছিলেন অপারেশন ওয়েস্ট এন্ড-এর পিছনে, যে তদন্তের ফলে তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, সে সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জর্জ ফার্নান্ডেজের পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়েছিলেন।
স্টিং অপারেশনের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের দু’মাস আগে থেকে আরম্ভ হয় এই অপারেশন। সারদা কাণ্ডে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের জড়িত থাকার অভিযোগ থেকেই নাকি তাঁরা এই স্টিং অপারেশনের পরিকল্পনা করেন।
ভিডিও-তে দেখা গেছে, ইমপেক্স কনসাল্টেন্সি নামে একটি কাল্পনিক সংস্থার প্রতিনিধিদের থেকে টাকা নিচ্ছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা। ফুটেজে দেখা গেছে, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, নির্বাচনের পর তিনি সংস্থার প্রতিনিধিদের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন। সুলতান আহমেদকে বলতে শোনা গিয়েছে যে কোনও চিঠি বা সুপারিশপত্রের প্রয়োজন হলে তিনি দিয়ে দেবেন।
নারদ নিউজের দাবি, তৃণমূল কংগ্রেসের যে নেতাদের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কেউই টাকার বিনিময়ে আইন ভাঙতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করেননি। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বর্তমান স্টিং অপারেশনের ভিডিও-টির সত্যতা এখনও প্রমাণিত হয়নি এবং বেনার নিউজ-ও এই ভিডিওর সত্যতা সম্বন্ধে কোনও দাবি করছে না।
তাতে অবশ্য রাজনৈতিক ঝড়ের গতি বিন্দুমাত্র প্রতিহত হয়নি। সিপিআইএম-এর রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বললেন, “স্টিং অপারেশনে যা দেখা যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর। তৃণমূলের নেতার মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা লুঠ করেছে। নির্বাচনের মুখে এত বড় ঘটনা সামনে এল। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক। প্রয়োজনে নির্বাচন স্থগিত রাখা হোক। তত দিন রাষ্ট্রপতি শাসন চলুক।”
বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বললেন, “মা-মাটি-মানুষের নাম করে ২০১১-এ এরা ক্ষমতায় এসেছিল। আজ এদের আসল পরিচয় বেরিয়ে পড়ল।“ মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করলেন কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য। বললেন, “তৃণমূলের ক্ষমতায় থাকার আর কোনও নৈতিক অধিকার নেই।”
এই ঘটনায় মুখ্যমন্ত্রীর কোনও প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র ডেরেক ও ব্রায়েন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, তাঁরা এই স্টিং অপারেশনটিকে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না। বিরোধীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করুন। নোংরা খেলার আশ্রয় নেবেন না।” তিনি আরও বলেন, “যে সংস্থাটি এই ভিডিও তুলেছে, তারা দু বছর ধরে সত্য ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল কেন? আজই বা তারা হঠাৎ ভিডিওটি প্রকাশ করল কেন?”
মুকুল রায় বললেন, “ভোটের আগে ষড়যন্ত্র। এটি জাল এবং সাজানো ভিডিয়ো। আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব।” সুলতান আহমেদ ও সৌগত রায় কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি। ফিরহাদ হাকিম বললেন, “কুৎসা রটাতে মিথ্যা ষড়যন্ত্র।“
স্টিং অপারেশনটিকে ঘিরে প্রশ্ন অবশ্য অনেক। এত টাকা এল কোথা থেকে? সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ম্যাথু স্যামুয়েলস জানিয়েছেন, দুবাই ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনাবাসী ভারতীয়রা এই টাকা দিয়েছেন। তাঁরা কারা, কেনই বা এত টাকা দিলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। একটি কাল্পনিক সংস্থার প্রতিনিধিদের থেকে এত টাকা নিলেন শাসক দলের তাবড় নেতারা, এটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই যদি অপারেশন হয়ে থাকে, তা প্রকাশ্যে আনতে এত সময় নিল কেন নারদ নিউজ?
তবে, সারদা কাণ্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের মন্ত্রী-সাংসদদের যুক্ত থাকার অভিযোগের নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই এই স্টিং অপারেশন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঝড় তুলে দিল। নির্বাচন কমিশনের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এখন কলকাতায়। ফলে, কোথাকার জল কোথায় দাঁড়ায়, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকছে পুরো মাত্রায়।