জোট-সম্ভাবনায় হঠাৎ বিপত্তি পশ্চিমবঙ্গে
2016.03.10
বিধানসভা নির্বাচনের যুদ্ধ জমে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গে।
নির্বাচনের দিন ঘোষণা হওয়ার ঢের আগেই সিপিআইএম এবং কংগ্রেস, উভয় দলই জানিয়েছিল যে তারা তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের পথে হাঁটতে চায়। সিপিআইএম-এর পলিটব্যুরো আর কংগ্রেসের হাইকম্যান্ড, উভয় শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেই রাজ্য নেতারা জোটের সম্মতি আদায় করেছিলেন। কিন্তু, আদৌ কি সেই জোট হবে? প্রশ্ন উঠে গেল বামফ্রন্টের সিদ্ধান্তেই।
৭ মার্চ আগে প্রথম প্রার্থীতালিকা প্রকাশ করেছিল বামফ্রন্ট। মোট ১১৬টি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। দেখা গিয়েছিল, সেই তালিকায় রয়েছে মুর্শিদাবাদের তিনটি আসনও। মুর্শিদাবাদ পরিচিত কংগ্রেসের শক্তি ঘাঁটি হিসেবে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর খাসতালুক এই জেলাটি। সেখানে তিনটি আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করাকে ভাল চোখে দেখেনি কংগ্রেস। তবুও, অধীর চৌধুরী বলেছিলেন, জোট হচ্ছে। প্রয়োজনে এই তিনটি আসনে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াই’ হবে।
কিন্তু আজ বামফ্রন্ট দ্বিতীয় দফার প্রার্থীতালিকা ঘোষণা করার পর বন্ধুত্বের রেশ মিলিয়ে এসেছে। কারণ, এই তালিকাতে মুর্শিদাবাদের আরও নয়টি আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে বামফ্রন্ট। জেলায় মোট আসন ২২টি। তার মধ্যে বারোটিতে বামফ্রন্ট প্রার্থী দিলে জোটের সম্ভাবনা কার্যত নাকচই হয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, এই বারোটি আসনের আটটিতেই কংগ্রেসের প্রার্থীও রয়েছে। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বীরভূম জেলার চারটি আসনেও কংগ্রেস এবং বামফ্রন্ট, উভয় তরফের প্রার্থীই রয়েছে।
স্বভাবতই চটেছেন অধীর চৌধুরী। তিনি বললেন, মানুষের ইচ্ছাকে সম্মান করেই আমরা জোটের পথে হাঁটতে চেয়েছি। দীর্ঘ আলোচনার পর আমরা আসনতালিকা তৈরি করেছি। এখন যদি বামফ্রন্ট ভাবে যে তারা আরও বেশি আসনে লড়বে, তা হলে কেউ যেন না ভাবেন যে কংগ্রেস সেই দাবি মেনে নেবে।
অধীর চৌধুরী জানিয়ে দিলেন, যেখানে কংগ্রেস সাংগঠনিক ভাবে মজবুত, সেখানে একাই লড়তে তৈরি তাঁরা। তাতে ত্রিমুখী লড়াই হলেও সমস্যা নেই। বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু অবশ্য বললেন, আসন নিয়ে সমস্যা হলে আলোচনা করাই যেতে পারে। এই তালিকাই যে চূড়ান্ত, তা নয়।
অভূতপূর্ব নিরাপত্তা
মার্চের গোড়ায় কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছিল, মোট সাত দফায় আয়োজিত হবে রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। প্রথম দফার ভোট হবে ৪ এপ্রিল, শেষ দফা ৫ মে। সাড়ে সাতশো কম্পানি কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী আসবে নিরাপত্তারক্ষার কাজে। নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হবে ১৯ মে।
গত বছর কলকাতা ও বিধাননগর সহ বেশ কয়েকটি পুরসভার নির্বাচনে তুমুল রিগিং ও নির্বাচনী সন্ত্রাসের অভিযোগ ওঠে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। নির্বাচনের দফা বৃদ্ধি এবং অভূতপূর্ব কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর উপস্থিতি কি সেই সন্ত্রাসেরই প্রতিক্রিয়া? প্রশ্ন উঠছে রাজনৈতিক মহলে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দৃশ্যতই খুশি নন কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তে। তিনি ব্যঙ্গাত্মক সুরে বললেন, “সবচেয়ে ভাল হত ২৯৪টি আসনে ২৯৪ দিন ভোট করলে!” কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতির প্রসঙ্গেও বললেন, “বাহিনী তো তিন দিন থাকবে। তার পর তো আমাদেরই দেখতে হবে।” রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী অস্বস্তিতে রয়েছেন বলেই তাঁর প্রতিক্রিয়া এমন আক্রমণাত্মক।
জোট না ঘোঁট
বামফ্রন্ট আর কংগ্রেসের জোট নিয়েও ব্যঙ্গাত্মক মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, ওরা আগে গোপনে জোট করত, এ বার প্রকাশ্যে এসেছে। ব্যঙ্গের সুরে বললেন, জোট করুক আর ঘোঁট করুক, মানুষ ওদের ভোট দেবে না।
আজ মালদায় এক নির্বাচনী জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী বললেন, “কংগ্রেস আর সিপিএম, দুই দলই জানে, একা লড়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে পরাস্ত করা অসম্ভব। তাই তারা রামধনু জোট বানিয়েছে। কিন্তু মানুষের জোট তাদের পরাজিত করবে।“
মুখ্যমন্ত্রী যতখানি নিশ্চিত, ততটা আশাবাদী নন কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের দুই অধ্যাপক সন্দীপ মিত্র ও শুভময় মৈত্র। বিগত নির্বাচনের ফলাফল, ভোটদানের গতিপ্রকৃতি ইত্যাদি বিশ্লেষণ করেছেন তাঁরা। বললেন, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। গোটা দেশের ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তবে পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি-র ভোট কমতে চলেছে। সেই ভোটের চল্লিশ শতাংশ যদি ঘুরে কংগ্রেস-বামফ্রন্ট জোটের দিকে চলে আসে, তবে তৃণমূল কংগ্রেস সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না। তবে, এর কম ভোট ঘুরলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চিন্তার কারণ নেই।
মদন মিত্রও প্রার্থী
প্রার্থীতালিকায় চমক দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কামারহাটির বিধায়ক ও তাঁর সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র এখন সারদা কাণ্ডে বিচারাধীন, জেলবন্দি। তাঁকে ফের কামারহাটি থেকেই মনোনয়ন দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী ইতিহাসে এই প্রথম কোনও জেলবন্দি নির্বাচনে প্রার্থী হলেন। মদন মিত্র মুখ্যমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহল বলছে, এই ঘটনা ভাল বার্তা দিচ্ছে না।
ভাঙড় কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন আবদুর রেজ্জাক মোল্লা। ১৯৭৭ থেকে ২০১১ অবধি টানা আট বার পার্শ্ববর্তী ক্যানিং পূর্ব কেন্দ্র থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন মোল্লা, তবে সিপিআইএম প্রার্থী হিসেবে। একদা দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাম নেতা রেজ্জাক মোল্লা দলবিরোধী কাজের জন্য সিপিআইএম থেকে বহিষ্কৃত হন এবং সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। তাঁকে দলে নেওয়ার পিছনে সংখ্যালঘু ভোট টানার তাগিদ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর, বললেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়।
এ ছাড়াও তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী হয়েছেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক ফুটবলার ভাইচুং ভুটিয়া, সদ্যপ্রয়াত ক্রিকেট প্রশাসক জগমোহন ডালমিয়ার কন্যা বৈশালী ডালমিয়া, ক্রিকেটার লক্ষ্মীরতন শুক্ল, গায়ক ইন্দ্রনীল সেন প্রমুখ। বামফ্রন্টের প্রার্থীতালিকায় চমক সূর্যকান্ত মিশ্র। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ সূর্যকান্ত মিশ্র এখন সিপিআইএম-এর রাজ্য সম্পাদক। দলের প্রথা, এই পদে আসীন নেতা মন দেবেন সাংগঠনিক কাজেই। তিনি ভোটে দাঁড়াবেন না।
এই প্রথম প্রথা ভাঙল দল। সিপিআইএম সরকার গড়তে পারলে সম্ভবত মুখ্যমন্ত্রী হবেন সূর্যকান্তই।