বাঘ-সিংহ অনাথ, কলকাতা চিড়িয়াখানা নতুন মা-বাবা খুঁজছে

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2016.01.07
Ind-zoo কলকাতার আলিপুর চিড়িয়খানায় ভিড় উপচে পড়লেও সেই চিড়িয়াখানার পশু-পাখিরা এখন অনাথ।
অনলাইন

এই শীতেই ভিড়ের রেকর্ড ভেঙেছে আলিপুর চিড়িয়াখানায়। বছরের প্রথম রবিবার এক লক্ষ মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন দেশের সবচেয়ে পুরনো সংগঠিত চিড়িয়াখানায়।

কিন্তু, সেই চিড়িয়াখানার পশু-পাখিরা এখন অনাথ।

হ্যাঁ, ভুল পড়েননি। সত্যিই তারা অনাথ হয়েছে।

২০১৩ সালে কলকাতা চিড়িয়াখানায় চালু হয়েছিল একটি বিশেষ প্রকল্প। বেশ কয়েকটি পশুপাখিকে আলাদা করে বেছে নেওয়া হয়েছিল। যে কোনও সাধারণ মানুষ বা কর্পোরেট সংস্থা বছরে একটা নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে দত্তক নিতে পারতেন তাদের। সে বছর উৎসাহী মানুষের ঢল নেমেছিল।

দত্তক দেওয়ার জন্য বেছে নেওয়া ৪২টি পশু-পাখির জন্য আবেদন জমা পড়েছিল কয়েকশো। হর্ষ নেওটিয়া থেকে সঞ্জয় বুধিয়া, আর এস অগ্রবাল অথবা আর এস গোয়েঙ্কা, শহরের সবচেয়ে নামীদামি শিল্পপতিরা যেমন এগিয়ে এসেছিলেন চিড়িয়াখানার পশু দত্তক নিতে, তেমনই ভিড় জমিয়েছিলেন সাধারণ মানুষও।

কিন্তু, সেই উৎসাহে ভাটা পড়তে সময় লাগেনি। গত বছর ২৫টি পশুকে দত্তক দেওয়া গিয়েছিল। আর এই বছর, সাকুল্যে ন’টি। বাঘ, সিংহ, গণ্ডার, সবাই অপেক্ষায় রয়েছে মা-বাবার।

চিড়িয়াখানার অধিকর্তা আশিস কুমার সামন্ত বললেন, “প্রথম অথবা দ্বিতীয় বছর যাঁরা দত্তক নিয়েছিলেন, এ বছর তাঁদের অধিকাংশই আর সেই দত্তকের পুনর্নবীকরণ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। তবে আমরা অন্য পশুপ্রেমীদের এই প্রকল্পে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছি।”

চিড়িয়াখানার পশু দত্তক দেওয়ার ধারণাটি একেবারে নতুন নয়। সান ডিয়াগো সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি চিড়িয়াখানায় এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে, হাতি দত্তক নিলে মেয়ের বিয়েতে সেই হাতিকে বরযাত্রীদের অভ্যর্থনা করার জন্য আনার কথা ভাববেন না যেন। অথবা, মিষ্টি দুটো বাঁদর দত্তক নেওয়ার পর তার খাঁচায় ঢুকে সেলফিও তোলা যাবে না। দত্তক নিলে কয়েকটা জিনিস অবশ্য পাবেন।

যে পশু দত্তক নেবেন, তার খাঁচায় আপনার অথবা আপনার সংস্থার নামের বোর্ড লাগানো থাকবে। সেই পশুর জন্মদিনে আপনি সপরিবার আমন্ত্রিত হবেন। আপনার দত্তক নেওয়া পশুটি কেমন আছে, তার চিকিৎসার প্রয়োজন কি না, চিকিৎসা কেমন চলছে, সেই সব খবরও জানানো হবে আপনাকে।

আসল কথা হল, পশুপ্রেমী মানুষকে তার পছন্দের পশুর কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্যই এই প্রকল্প। অবশ্য, তার অর্থকরী দিকও আছে। এক বছরের জন্য একটি পশুকে দত্তক নেওয়ার খরচ দশ হাজার টাকা থেকে দেড় লক্ষ টাকা। যার চাহিদা বেশি, স্বভাবতই তাকে দত্তক নিতে খরচও তত বেশি। আর, সেই তালিকার একেবারে ওপরে রয়েছে বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ। পিছিয়ে নেই হাতি, গণ্ডারও।

চিড়িয়াখানার প্রাক্তন অধিকর্তা কে এল ঘোষ জানালেন, “দত্তকের মাধ্যমে প্রথম বছরেই প্রায় ত্রিশ লক্ষ টাকা আয় করেছিল কলকাতা চিড়িয়াখানা।” এমনিতেই চিড়িয়াখানা অর্থাভাবে ভুগছে। এ বছর দত্তক নেওয়ার উৎসাহ সাংঘাতিক রকম কমে যাওয়ায় তার প্রভাব পড়ছে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক স্বাস্থ্যের ওপরেও।

দু’বছর আগেও যাঁরা প্রবল উৎসাহী ছিলেন, তাঁরা হাত গুটিয়ে নিলেন কেন? কী হল এই ক’দিনে, যাতে ছবিটা সম্পূর্ণ উল্টে গেল? বিজ্ঞাপন জগতের খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব রংগন চক্রবর্তী বললেন, “একটা কারণ সম্ভবত চিড়িয়াখানার ভুল বিপণন স্ট্র্যাটেজি। এ রকম চমৎকার একটা প্রকল্প চলছে, অথচ তার কোনও বিজ্ঞাপন নেই, কোথাও সে বিষয়ে আলোচনা নেই। এমনকী, চিড়িয়াখানার ওয়েবসাইটে দত্তক নেওয়া সংক্রান্ত কোনও তথ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে না। আজকের দুনিয়ায় এ ভাবে চললে মানুষ উৎসাহী হবেন কেন?”

দিল্লির অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা টেরি-র অর্থনীতিবিদ শাশ্বত চৌধুরী বললেন, “এই কথাটাও মনে রাখা দরকার যে কলকাতা এখন মূলত গরিবদের শহর। ফলে, এই রকম ক্ষেত্রে টাকা খরচ করার সংস্কৃতিও কলকাতায় কম। এ কথা বলছি না যে কলকাতায় বছরে দেড় লাখ টাকা খরচ করার মতো লোক নেই। কিন্তু, চিড়িয়াখানায় পশু দত্তক নেওয়ার জন্য টাকা খরচ করতে একটা বিশেষ মানসিকতা প্রয়োজন। কলকাতায় সম্ভবত সেটার অভাব।”

কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী অদ্রিজা ব্যানার্জী যবে থেকে শুনেছে যে এখন বাঘ-সিংহের মা-বাবা নেই, ভয়ানক মনখারাপ তার। নিজের বাবাকে সমানেই বলে চলেছে, তুমি টাইগারের বাবা হও না, প্লিজ। মেয়ের কথা শুনেই নেবেন কি না, দ্বিধায় রয়েছেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর কর্মী সুগত।

অদ্রিজারাই এখন আলিপুর চিড়িয়াখানার অনাথ পশুপাখিদের ভরসা।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।