এবার ‘নব্য জেএমবি’ সন্দেহে দুই জঙ্গি দম্পতি গ্রেপ্তার
2016.09.07

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষানবিশ চিকিৎসকসহ চার নারীর জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার খবরের রেশ কাটতে না কাটতেই এবার দুই জঙ্গি দম্পতিকে আটক করার কথা বলছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব। এই খবর বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ‘নব্য জেএমবি’ সন্দেহে ওই দুই দম্পতিকে আটক করা হয়। এরা হলেন; মারজিয়া আক্তার সুমি (১৯) ও তার স্বামী শরিফুল ইসলাম ওরফে সুলতান মাহমুদ ওরফে মাহমুদ (১৮) এবং নাহিদা সুলতানা (৩০) ও তার স্বামী আমিনুল ইসলাম (৩৪)।
র্যাব বলছে, মারজিয়ার বাড়ি পাবনায়, শরিফুলের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের মেলান্দহে। আমিনুলের বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে এবং নাহিদার বাড়ি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। এরা নব্য জেএমবির সদস্য।
র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনের সিদ্ধান্তে তারা বিয়ে করেন এবং প্রশিক্ষণ নিতে পাকিস্তান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
শেরেবাংলা নগরে র্যাব-২-এর কার্যালয়ে গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান এই তথ্য জানান।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, নব্য জেএমবির বেশ কয়েকজন সদস্য জিহাদের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-২-এর একটি দল গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফার্মগেটে একটি রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে মারজিয়া, তার স্বামী শরিফুল এবং আমিনুলকে আটক করে।
তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাত তিনটার দিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অভিযান চালিয়ে নাহিদা সুলতানাকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে জিহাদি বই, লিফলেট, সিডি ও মুঠোফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, আটক মারজিয়া প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ফেসবুকের মাধ্যমে তিনি নব্য জেএমবির সঙ্গে যুক্ত হন। এরপর নব্য জেএমবির থ্রিমা ও টেলিগ্রাম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন।
এই গ্রুপের কাজ হলো বাছাইকৃত সদস্যদের দেশে একটি করে অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া এবং অভিযান সফল হলে বিদেশে নিরাপদ স্থানে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
এই গ্রুপ থেকেই আফিফ, কাইফ, জাইশান, মফিজসহ আরও অনেকের সঙ্গে তার কথা হয়। এভাবেই তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন।
এরপর মারজিয়া গত ২০ আগস্ট পাবনার সুজানগরের বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরে সংগঠনের সিদ্ধান্তে শরিফুলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তারা দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছিলেন।
মুফতি মাহমুদ বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে শরিফুলও নিজেকে নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্য বলে জানিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি এড়াতে এই দম্পতি দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
জিজ্ঞাসাবাদে আমিনুল বলেছেন, তিনি ও তার স্ত্রী নাহিদা নব্য জেএমবির সক্রিয় সদস্য। তিনি সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নির্দেশে অপারেশনাল কর্মকাণ্ডের জন্য লোক সংগ্রহ করতেন।
দুই সন্তানের বাবা আমিনুল সংগঠনের সিদ্ধান্তে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে নাহিদাকে বিয়ে করেন এবং দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছিলেন।
নাহিদা জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে জঙ্গি কার্যক্রমে যুক্ত হন। পরে দাওলাতুল ইসলাম অ্যাপস ব্যবহার করতেন। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে তিনি গত ২২ মে আমিনুলকে বিয়ে করেন।
মুফতি মাহমুদ খান বলেন, দেশে নব্য জেএমবির চার-পাঁচ সদস্যের কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তারা হত্যাসহ আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বেনারকে জানিয়েছে, “গত ১৫ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ইসতিসনা আক্তার ঐশীসহ যে চার ‘সন্দেহভাজন নারী জঙ্গিকে’ গ্রেপ্তার করা হয় তাদের সূত্র ধরেই এই দুই দম্পতিকে শনাক্ত করা হয়।”
ইসতিসনা জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাচিপের সাবেক সভাপতি বিশ্বাস আক্তার হোসেনের মেয়ে।
বাকি তিনজন বেসরকারি মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী। র্যাব তখন জানায়, দলটির প্রধান মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি (সম্মান) বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী আকলিমা রহমান মনি।
আকলিমাই পরে ইসতিসনা আক্তার এবং মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ছাত্রী ইশরাত জাহান মৌসুমি ওরফে মৌ এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদিজা পারভিন মেঘলাকে দলে ভেড়ান।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওই সূত্র বলছে, আগের এই চারজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী মারজিয়া আক্তারকে শনাক্ত করা হয়।
মারজিয়ার গ্রামের বাড়ি পাবনার সুজানগরে। সে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বিজ্ঞান শাখার প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তার বাবা মনসুর আলী সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার।
গত ২০ আগস্ট থেকে মারজিয়া নিখোঁজ ছিল। এ বিষয়ে তার বাবা ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেন। মারজিয়ার বাবা মনসুর আলী স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “মেয়ের উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়া বা বিশেষ কোনো বন্ধুর কথা তাঁদের জানা নেই। তাঁদের সন্তান লেখাপড়ায় ভালো। বাইরে খুব একটা যাওয়া-আসা ছিল না। তবে রাব্বি নামে একটি ছেলে মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করত। সে ইজিবাইক চালায়।”
তিনি বলেন, গত ১৬ আগস্ট সকালে কলেজে যাওয়ার পথে ওই ছেলেটি তাঁদের মেয়েকে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির নিচে ডেকে নিয়ে যায় এবং ছুরি দেখিয়ে গলায় থাকা সোনার চেইন জোর করে ছিনিয়ে নেয়। তখন স্থানীয় লোকজন ছেলেটিকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ করে।
ওই দিনই তিনি বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানায় ছেলেটিকে আসামি করে মামলা করেন। পরদিন ২০ আগস্ট সকাল পৌনে আটটার দিকে তাঁদের মেয়ে পড়তে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়। এরপর আর ফিরে আসেনি।
জানতে চাইলে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “মেয়েটির বাবা যে ছেলেটির বিষয়ে অভিযোগ করেছিলেন, তাকে ওই দিনই গ্রেপ্তার করা হয়। মেয়েটির বাবা যখন ছেলেটির বিরুদ্ধে মামলা করতে আসেন, তখনো মেয়েটি বাবার সঙ্গে ছিল এবং স্বাভাবিক ছিল।” তিনি বলেন, জঙ্গিবাদের সঙ্গে তার জড়িয়ে পড়ার বিষয়ে পুলিশ এখনো কিছু জানে না।
“র্যাব মারজিয়াকে আটকের বিষয়টি পুলিশকে জানায়নি। তারা বিষয়টি তদন্ত করছেন। তবে উগ্রবাদের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা এখনো স্পষ্ট নয়,” বেনারকে জানান কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম।