এবার মীর কাসেম আলীর পালা,প্রাণভিক্ষার সুযোগ বাকি

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.08.30
20160830-Meer-Kashem1000.jpg মীর কাসেম আলীর রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগ খারিজ করার পর বিকেলে লাল ফাইলে মোড়া রায়ের অনুলিপি কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছানো হয়। আগস্ট ৩০, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

রায় পুনর্বিবেচনার আনুরোধ জানিয়ে একাত্তরের কুখ্যাত আলবদর বাহিনীর নেতা মীর কাসেম আলীর করা আবেদন গতকাল মঙ্গলবার খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। গতকাল বিকেলে রায়ের অনুলিপি উচ্চ আদালত থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে সন্ধ্যায় কারাগারে পৌঁছানো হয় তার মৃত্যু পরোয়ানা।

এর ফলে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে—এমন আবহ তৈরি হয়েছে। এখন মীর কাসেম আলীর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবার সুযোগ আছে।

রিভিউতে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করে আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, “আজ আমাদের সকলের জন্য একটি স্বস্তির দিন। বাংলাদেশের জনগণের সাথে আমিও আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছি।”

গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটেও রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে মীর কাসেম আলীর করা আবেদন খারিজের ২৯ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ করা হয়েছে। মীর কাসেম বর্তমানে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২–এ ফাঁসির কনডেমড সেলে বন্দী আছেন।

এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ডের প্রতিবাদে আগামিকাল বুধবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী।

মীর কাসেম আলী। ফাইল ফটো।

মীর কাসেমকে জামায়াতের ধন কুবের বলে মনে করা হয়। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগের ষড়যন্ত্রে যুক্ত বলেও অভিযোগ আছে।

“আমি বারবার চিৎকার করে বলেছি, মিথ্যা সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সাজা দেওয়া হয়েছে। আমার আর কিছু বলার নেই,”বেনারকে জানান মীর কাসেমের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।

মীর কাসেম হলেন ষষ্ঠ যুদ্ধাপরাধী, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের পর্যায়ে এসেছে। এর আগে জামায়াতের কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও মতিউর রহমান নিজামী এবং বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদন আপিল বিভাগে খারিজ হয়ে যায়। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাদের দণ্ড কার্যকর করে সরকার।

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ মীর কাসেমের রিভিউয়ের রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দুটি অভিযোগে মীর কাসেমকে ফাঁসি ও আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের রায় প্রদান করেন। ওই বছর ৩০ নভেম্বর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন মীর কাসেম।

চলতি বছর ৮ মার্চ আপিল বিভাগের রায়ে ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের ফাঁসির আদেশ বহাল রেখেন এবং অন্য ছয়টি অভিযোগে তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।

গত ৬ জুন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাসেম। ২৪ আগস্ট তার আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয়।

২০১২ সালের ১৭ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মীর কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।

উল্লেখ, ৭১’এ জামায়াতের এই নেতা ছিলেন দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি এবং কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান।

তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা এলাকার ডালিম হোটেলে স্থাপিত হয় আলবদর বাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র। এই ডালিম হোটেলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ। ফলে ওই সময় ডালিম হোটেল মানুষের কাছে পরিচিতি পায় ‘হত্যাপুরী’ হিসেবে।

ফাঁসি কার্যকর নিয়ে জল্পনাকল্পনা

মীর কাসেমের ফাঁসির রায় কবে কার্যকর হবে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা–কল্পনা। এর আগের রায়গুলো বাস্তবায়নের আগে পালিত প্রক্রিয়াগুলো মীর কাসেমের ক্ষেত্রেও থাকছে।

সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে দণ্ডাদেশ পাওয়া সব আসামিই শেষ সুযোগ হিসেবে প্রাণভিক্ষা চাইতে পারে। একাত্তরের হত‌্যাকারী মীর কাসেমকেও সে সুযোগ দেওয়া হবে।

“মীর কাসেম রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন, তার সেই অধিকার আছে। তিনি ক্ষমা চাইলে তা রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছাবে, সেই প্রক্রিয়া শেষ হলেই রায় কার্যকর হবে,” বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “তিনি (কাসেম) যদি মনে করেন প্রাণভিক্ষা চাইবেন, তার দরখাস্ত রাষ্ট্রপতির কাছে প্রেরণ করা হবে। রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তের পরই দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হবে।”

রায়ের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি—সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এই রায় দ্রুত কার্যকরের পাশাপাশি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি জানান।

“ব্যক্তির পাশাপাশি যেসব রাজনৈতিক দল ও শক্তি যুদ্ধাপরাধের সাথে জড়িত ছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে,” বেনারকে জানান সেলিম।

একাত্তরে মীর কাসেম আলীর টর্চার সেল চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে তার ও তার সহযোগীদের হাতে নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ওই ঘাতকের সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়েছেন। একাত্তরে নভেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রাম শহরের কদমতলী এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায় মীর কাসেম ও তার সহযোগীরা।

“ডালিম হোটেলে অন্য বন্দীদের সঙ্গে আমার ওপরও ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়, যার বিবরণ ট্রাইব্যুনালে দেওয়া সাক্ষ্যে তুলে ধরেছি,” বেনারকে জানান জাহাঙ্গীর চৌধুরী।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।