প্রাণভিক্ষা চাইবেন না মীর কাসেম,ফাঁসি যে কোনো সময়

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.09.02
20160902-Meer-Qasem620.jpeg ৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হওয়া বাংলাদেশ জামায়াত-ই- ইসলামীর ধন কুবের মীর কাসেম আলীকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নেয়ার পথে ভক্তদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন। নভেম্বর ২,২০১৪।
এএফপি

ছেলের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানানোর একদিনের মাথায় অবস্থান পরিবর্তন করেছেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী। শুক্রবার জেল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবেন না।

৬৩ বছর বয়সী মীর কাসেম এই সিদ্ধান্ত জানানোর পর যে কোনো মুহূর্তে ফাঁসি কার্যকর হতে পারে। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানায়, শনিবার রাতে ফাঁসি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোনো কারণে তা রোববারও হতে পারে।

এর আগে ৩১ আগস্ট স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুনের মাধ্যমে মীর কাসেম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, নিখোঁজ ছেলেকে ফিরে পেলে তার সঙ্গে পরামর্শ করেই প্রাণভিক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। গত ৬ আগস্ট তার ছেলে ব্যারিস্টার আহম্মেদ বিন কাসেমকে বাসা থেকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গেছে, যিনি তার বাবা মীর কাসেমের একজন আইনজীবী।

কিন্তু গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার কারা কর্তৃপক্ষের কয়েক দফা প্রশ্নের জবাবে মীর কাসেম প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। কারা কর্তৃপক্ষ এই দাবি করলেও পারিবারিক একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে বলেন, মীর কাসেম ছেলেকে ফিরে পাওয়াসাপেক্ষে তার সঙ্গে পরামর্শ করে প্রাণভিক্ষার সিদ্ধান্ত নেবেন, এমন অবস্থানে অটল আছেন।

কবে, কখন তার ফাঁসি কার্যকর করা হবে—সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।

“মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে,” বেনারকে জানান কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ এর জেলার নাশির আহমেদ।

নিয়ম অনুযায়ী, দণ্ড কার্যকরের আগে আরও এক দফা পরিবারের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন জামায়াতে ইসলামীর সুরা সদস্য মীর কাসেম আলী, যিনি একাত্তরে ছিলেন ‘চট্টগ্রামের ত্রাস’। নির্মমতার জন্য চট্টগ্রামে ‘বাঙালি খান’ নামে পরিচিতি পান তিনি।

২০১৪ সালে মীর কাসেমকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। চলতি বছর মার্চে আপিল বিভাগেও সেই রায় বহাল থাকায় তিনি রিভিউ আবেদন করেন।

প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ গত মঙ্গলবার কাসেমের রিভিউ আবেদন খারিজ করে দিলে এ মামলার সব বিচারিক প্রক্রিয়ার পরিসমাপ্তি ঘটে।

সেদিন সন্ধ্যায় পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে পরদিন সকালে তা আসামিকে পড়ে শোনায় কারা কর্তৃপক্ষ। গতকাল তিনি প্রাণভিক্ষা না চাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ায় আদালতের রায় অনুসারে তার ফাঁসি কার্যকরে এখন আর কোনো বাধা থাকল না।

একাত্তরে মীর কাসেমের নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ‘ডালিম হোটেল’। সেখানে তার নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন্দিশিবির ও টর্চার সেল। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর্যবেক্ষণে সেই ডালিম হোটেলকে বলা হয় ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’।

১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যে কোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। তাঁকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়।

নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলে আরও পাঁচজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির লাশসহ তাঁর মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এই অপরাধেই  ফাঁসির রায়  হয় মীর কাসেম আলীর।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হয়। মীর কাসেম হলেন ষষ্ঠ যুদ্ধাপরাধী, যার সর্বোচ্চ সাজার রায় কার্যকরের পর্যায়ে এসেছে। তিনি হলেন জামায়াতের পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চার দশক আগের অপরাধের কারণে যাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হচ্ছে।

এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের আরো চার নেতার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরা হলেন, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা(১২ ডিসেম্বর, ২০১৩), জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান (১১ এপ্রিল, ২০১৫), জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ(২১ নভেম্বর, ২০১৫) এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী(১১ মে, ২০১৬)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত বছর ২১ নভেম্বর জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের সাথে একই দিনে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

জামায়াতের চার নেতার ফাঁসি কার্যকর হওয়া, একজনের ফাঁসির জন্য অপেক্ষা, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত গোলাম আজমের কারাগারে মৃত্যু এবং দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর আজীবন জেলে থাকার রায় ঘোষণার পর দলটি ঝিমিয়ে পড়েছে। এই সাতজন ছিলেন দলের নীতি নির্ধারক।

সরকার এখন যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির নিবন্ধন বাতিল করার চিন্তা–ভাবনা করছে। “এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নির্দেশনা রয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী মন্ত্রিসভার বিবেচনার জন্য একটি খসড়া আইনের প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো হয়েছে,” বেনারকে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।