মীর কাসেমের ফাঁসিতে পাকিস্তান ও তুরস্কের প্রতিক্রিয়া

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.09.06
20160906-Meer-Quasem-FOLO1000.jpg মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের চালা গ্রামে দাফন করা হয়। সেপ্টেম্বর ৪, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো

আবারও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-তুরস্কের মধ্যকার সম্পর্ক। ১৯৭১ সালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে দেশ দুটি।

এটা আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বলে মনে করছে বাংলাদেশ। সরকারের পক্ষ থেকে এসব প্রতিক্রিয়ার কড়া জবাবও দেওয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, একটি স্বাধীন দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এমন আচরণ কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। এ ছাড়া পাকিস্তান বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যই শুধু করছে না, এ বিচারকে বিশ্ব দরবারে বিতর্কিত করার চেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে।

এ আচরণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পাশাপাশি আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন তাঁরা।

পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

গত সপ্তাহে মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে মীর কাসেম আলীর করা আপিল আবেদন খারিজ করে দেয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। এর পরপরই কোন কারণ উল্লেখ না করেই দু’দেশের মধ্যকার পূর্ব নির্ধারিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক স্থগিত করে পাকিস্তান।

গত শনিবার রাতে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের পর গভীর রাতে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি প্রকাশ করে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২০১৩ সালের ডিসেম্বরে প্রথম যুদ্ধাপরাধী আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর এমন প্রতিটি ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে আসছে একাত্তরে পরাজিত দেশটি।

ত্রুটিপূর্ণ বিচার দাবি পাকিস্তানের

পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ দাবি করা হয়। এতে বলা হয়, ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের আগে অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর বিশিষ্ট নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় পাকিস্তান গভীরভাবে মর্মাহত। দেশটির পক্ষ থেকে মীর কাসেম আলীর শোকাহত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সহানুভূতি জানানো হয়।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, শুরু থেকেই এই আদালতের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে বিচার প্রক্রিয়ার সুষ্ঠুতা ও স্বচ্ছতার পাশাপাশি অভিযুক্তদের আইনজীবী ও সাক্ষীদের হয়রানি নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছিল।

শুধু বিবৃতিতে নয়, পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী ইসলামাবাদে মীর কাসেম আলীর গায়েবানা জানাজা আয়োজন করে। এ ছাড়া দলটি সেখানে অবস্থান কর্মসূচিরও ডাক দিয়েছে।

আবারও তুরস্কের প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তানের পর মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় ‘মর্মাহত’ হয়ে প্রতিক্রিয়া জানায় তুরস্ক। গত রোববার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মীর কাসেম আলীকে জামায়াতের ইসলামির প্রধান অর্থ জোগানদাতা হিসেবে উল্লেখ কর হয়। এতে বলা হয়, “আমরা আবারও জোর দিয়ে বলছি যে, এ পদ্ধতিতে (মৃত্যুদণ্ড) অতীতের ক্ষত সারানো যাবে না এবং আমরা আশা করি এই ভুল চর্চা বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতিম জনগণের মধ্যে বিভেদ বাড়াবে না।”

দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর ঠেকাতে বার বার বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়েপ এরদোয়ান।

গত মে মাসে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকরের পর তুরস্কের ঢাকার রাষ্ট্রদূতকে দেশে ডেকে পাঠালে দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। তবে তিন মাস পর ঢাকা ফিরে তুরস্কের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছিল, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর ইচ্ছে নেই।

বাংলাদেশের কড়া জবাব

এদিকে যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে পাকিস্তান ও তুরস্কের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কড়া জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকায় তুরস্ক দূতাবাসেও পাঠানো হয় প্রতিবাদপত্র।

গত রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢাকায় পাকিস্তানের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সামিনা মেহতাবকে তলব করে অতিরিক্ত সচিব কামরুল হাসান তাঁর কাছে পাকিস্তানের বিবৃতির প্রতিবাদ হিসেবে একটি কূটনৈতিক পত্র তুলে দেন।

এই প্রতিবাদ পত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে একাত্তরের মানবতাধিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার বিচার নিয়ে পাকিস্তান ক্রমাগতভাবে যে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালাচ্ছে, তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রতি একটি বড় ধরনের আঘাত।

এতে আরও বলা হয়, পাকিস্তান মীর কাসেম আলীর মতো যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের গণহত্যাযজ্ঞের সঙ্গে নিজেদের সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়টি আবারও স্বীকার করে নিল।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত পররাষ্ট্রসচিব কামরুল আহসান সাংবাদিকদের বলেন, “পাকিস্তান মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের বিষয়ে যে মতামত দিয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল।”

এদিকে সোমবার ঢাকায় তুরস্ক দূতাবাসে পাঠানো এক প্রতিবাদপত্রে মীর কাসেমের ফাঁসির পর তুরস্কের দেয়া বিবৃতি অনাকাঙ্ক্ষিত বলে জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এ ধরনের প্রতিক্রিয়া একটি সার্বভৌম দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বলে আবারও দেশটিকে সাবধান করে বাংলাদেশ।

এছাড়া পাকিস্তান ও তুরস্ককে দেওয়া প্রতিবাদপত্রে জানানো হয়, কোন রাজনৈতিক পরিচয় বা সম্পৃক্ততা নয়, ১৯৭১ সালে মীর কাসেম আলীর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আমলে নিয়েছেন। ওই সময় চট্টগ্রামে গণহত্যা পরিকল্পনা, প্ররোচনা, বাস্তবায়ন, হত্যা, নির্যাতনসহ আরো অন্যান্য অপরাধে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যরিস্টার তুরিন আফরোজ বেনারকে বলেন, “প্রতিটি ফাঁসির পর পাকিস্তানের মায়া কান্না বলে দেয় আমাদের বিচার সঠিক এবং ন্যায়ের পথে এগোচ্ছে।”

তুরস্কের প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “একটি গণহত্যাকারী দেশ কখনোই গণহত্যার বিচারের পক্ষে অবস্থান নেবে না, এটাই স্বাভাবিক।”

প্রভাব পড়তে পারে সার্ক সম্মেলনে

বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের বিষয়ে পাকিস্তান এখনো একাত্তরের মানসিকতা থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধীতা করে আসছে। আগামী নভেম্বরে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলনে এর প্রভাব পড়তে পারে।

নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো একটি সদস্যদেশ অংশ না নিলেই সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. দেলোয়ার হোসাইন বেনারকে বলেন, “এমন বিরূপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে বাংলাদেশ ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক সম্মেলনে অংশ নেবে কিনা সেটা নিয়ে সংশয় দেখা যাচ্ছে এবং এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তান সার্ক চার্টার অমান্য করেছে। এর ফলে দেশটি সার্ক সম্মেলন আয়োজনের নৈতিকতাও হারিয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।