সব এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেবে মালয়েশিয়া
2018.08.15
ঢাকা
প্রভাবশালী ১০ এজেন্সির সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে বাংলাদেশের সব রিক্রুটিং এজেন্সিকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেওয়ার ঘোষণাকে ‘ইতিবাচক’ মনে করছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ মঙ্গলবার ওই ঘোষণা দেন। তবে দুই দেশের মধ্যে এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি।
বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান সচিব ড. নমিতা হালদার বুধবার বেনারকে বলেন, “আমাদের সরকারিভাবে কোনও চিঠি দেওয়া হয়নি। আমরাও সংবাদমাধ্যমে খবরটি জেনেছি।”
১০ এজেন্সির এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা, তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন এই কর্মকর্তা।
“এটা খুবই ‘পজেটিভ’ ঘোষণা। শুরু থেকেই আমি বলে আসছি, কোথাও এমন কোনো সিন্ডিকেট রাখা যাবে না,” বুধবার বেনারকে বলেন সাবেক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
মালয়েশিয়ার পার্লামেন্ট ভবনে বিদেশি কর্মীদের ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বৈঠকের পর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ জানান, সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে।
মালয়েশিয়াকে তাঁরা জানিয়েছে, মাত্র ১০টি এজেন্সি একচেটিয়া কর্মী পাঠানোর সুযোগ পায় বলে মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু বাংলাদেশি কর্মীদের জনপ্রতি ২০ হাজার মালয়েশীয় রিঙ্গিত দিতে হয় এজেন্সিগুলোকে।
“তাই বাংলাদেশ থেকে যেসব অনুমোদিত এজেন্সী বিদেশে কর্মী পাঠায় শিগগিরই তাদের সবাইকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অনুমোদন দেওয়া হবে। এতে করে এজেন্সিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে,” বলেন মাহাথির।
বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান অনুবিভাগের প্রধান ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনও বেনারকে বলেন, “আমাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ‘অফিসিয়ালি’ কোনও ‘কমিউনিকেশন’ হয়নি।”
মন্ত্রণালয়ের এই অতিরিক্ত সচিবের অভিমত, “মালয়েশিয়া সরকারের এই সিদ্ধান্ত আমাদের এখানে খুবই ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এজেন্সিগুলোর মধ্যে এখন সুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হবে।”
“মনোপলির পরিবর্তে ফেয়ার কম্পিটিশন হলে তখন ‘কনজিউমার’, অর্থাৎ মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু সাধারণ শ্রমিকেরাই সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে। অভিবাসন ব্যয় অনেক কমে যাবে,” যোগ করেন ড. সালেহীন।
‘প্রতারণাপূর্ণ ব্যবসা বন্ধ হবে’
গত জুন থেকে বাংলাদেশের শ্রমিক নেওয়া বন্ধ রেখেছে মালয়েশিয়া। তখনই দেশটির শ্রমবাজারে দুই বছর ধরে ‘একচেটিয়া’ ও ‘প্রতারণাপূর্ণ’ ব্যবসা করা দশ বাংলাদেশি এজেন্সির প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়।
মালয়েশিয়ার কাছে অভিযোগ ছিল, এই সিন্ডিকেট বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ অভিবাসন ব্যয়ে সেখানে প্রায় দুই লাখ কর্মী পাঠিয়েছে। প্রথমে তাদের মাত্র ৩৭ হাজার টাকা ব্যয়ে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও পরে জনপ্রতি কমপক্ষে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে চলতি বছরেই এক লাখ নয় হাজার ৫৬২ জন শ্রমিক পাঠিয়েছে তারা।
“এই মানুষগুলোকে নিয়ে এভাবে ব্যবসা করা ঠিক না। তারা ভিটেমাটিসহ সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশে যায়। তারপর ওখানে গিয়ে চরম বিপদের মধ্যে পড়ে। অভিভাবসন ব্যয়ের টাকা ওঠানোর জন্য তিন বেলা কাজ করে,” বলেন বাংলাদেশের সাবেক বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী মোশাররফ।
২০১২ সালে শুধু সরকারি মাধ্যমে জি-টু-জি পদ্ধতিতে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর চুক্তি সই করেছিল বাংলাদেশ। পরে ২০১৬ সালে তা পরিমার্জন করে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিকেও এ কাজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এরপর বাংলাদেশ দুই দফায় ৯৫৭টি এজেন্সির নাম পাঠালেও মালয়েশিয়ায় বিদেশি কর্মী নিয়োগের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা সংস্থা মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ দেয়। এ নিয়ে অভিযোগ ওঠার কারণেই গত জুনে মালয়েশিয়া কর্মী নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়।
এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার বাংলাদেশের সব এজেন্সিকে শ্রমিক পাঠানোর অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মালয়েশিয়া।
“এবার একচেটিয়া এবং প্রতারণাপূর্ণ ব্যবসার মাধ্যমে লোকজনের সর্বস্ব হাতিয়ে নেওয়া বন্ধ হবে,” বেনারকে বলেন কুয়ালালামপুরে অবস্থানকারী বাংলাদেশী যুবক মোহাম্মদ খোকন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) কার্যনির্বাহী কমিটির সদ্য সাবেক সভাপতি বেনজির আহমেদ এর মতে, “এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক ঘটনা।”
“এর ফলে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো শুরু হবে। তবে বিষয়টি যেহেতু এখন ছড়িয়ে যাবে, এক্ষেত্রে নজরদারি আরো বাড়াতে হবে। যাতে কেউ শ্রমিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিতে না পারে,” বেনারকে বলেন বেনজির।
তবে ঢালাওভাবে সব এজেন্সিকে সুযোগ দেবার পক্ষপাতি নন শ্রম-অভিবাসন বিশেষজ্ঞ হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
তিনি বেনারকে বলেন, “যদিও মাহাথির ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ থেকে সব রিক্রুটিং এজেন্সি লোক পাঠাতে পারবে। কিন্তু সব নয়, যোগ্য এজেন্সিগুলো, যাদের সুনাম আছে, অতীত রেকর্ড ভালো; তাদেরই শুধু সুযোগ দেওয়া দরকার।”
কিরণের অভিমত, উল্লেখিত সিন্ডিকেটের ১০ এজেন্সির বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সিন্ডিকেটের ওই ১০ এজেন্সির মালিকেরা সকলেই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনারকে জানান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা।
এদিকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশে বিদেশি কর্মীদের বিভিন্ন বিষয় দেখভালের জন্য মাহাথির একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে চান বলে জানিয়েছেন। যে দেশ থেকেই কর্মী নিয়োগ দেয়া হোক না কেন, সবাইকে ওই স্বাধীন কমিশনের একক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে চান তিনি।
অবৈধ শ্রমিকদের ফিরতে হবে
বৈধ কাগজপত্র ছাড়া মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত শ্রমিকদের চলতি মাসের ৩১ তারিখের মধ্যে স্বদেশে ফিরে যেতে হবে। ওই সময়ের পর বিধি লঙ্ঘনকারী কেউ গ্রেফতার হলে তার সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার রিঙ্গিত জরিমানাসহ পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবৈধ অভিবাসীদের চিরুনি অভিযানের মুখে পড়তে হবে বলে সম্প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ।