বাংলাদেশ থেকে প্রথম কার্ডিনাল মনোনীত হলেন প্যাট্রিক ডি রোজারিও
2016.10.11

বাংলাদেশে রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মগুরু প্যাট্রিক ডি রোজারিওকে নতুন কার্ডিনাল মনোনীত করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম কার্ডিনাল হলেন।
গত রোববার সাপ্তাহিক ভাষণে ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস নতুন ১৭ কার্ডিনালের নাম ঘোষণা করেন, যা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ হয়। আগামী ১৯ নভেম্বর তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে কার্ডিনাল হিসেবে অভিষিক্ত হবেন বলে পোপ জানান।
বর্তমানে ১২০ জন কার্ডিনাল রয়েছেন, যাদের বয়স ৮০ বছরের নিচে। কোনো পোপ মারা গেলে কিংবা কেউ অবসরে গেলে নতুন পোপ নির্বাচন করে যে ‘কলেজ অব ইলেক্টর’, কার্ডিনালরা সেই পর্ষদের সদস্য।
নতুন কার্ডিনালদের মধ্যে বাংলাদেশি প্যাট্রিক রোজারিওসহ ১৩ জনের বয়স ৮০ বছরের নিচে হওয়ায় তাঁরা পোপ নির্বাচনের অধিবেশনে যোগ দিতে পারছেন। নতুন অন্য চার কার্ডিনালের বয়স ৮০ বছরের বেশি।
কার্ডিনালদের মধ্যে থেকেই নির্বাচিত হন পোপ। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম কেউ পোপ পদে যাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করলেন।
“এটা আমার ব্যক্তিগত স্বীকৃতি নয়, এটা গোটা বাংলাদেশের একটা বড় অর্জন। তা ছাড়া আমার এই মনোনয়ন আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির চমৎকার দৃষ্টান্ত,” মঙ্গলবার বেনারকে জানান প্যাট্রিক ডি রোজারিও।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ, সেখানে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীর সংখ্যাও খুবই কম। ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৫০ লাখ মানুষ খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী (ক্যাথলিক ৩০ লাখ। আমরা ভ্যাটিকান থেকে অনেক দূরে, কিন্তু শত শত বছর ধরে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি লালন করে আসছি।”
এই মনোনয়ন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ–আলোচনা ও যোগাযোগের সুযোগ প্রশস্ত করবে বলে জানান প্যাট্রিক ডি রোজারিও।
বাংলাদেশি প্যাট্রিক রোজারিও ছাড়া অন্য ১৬ জন এসেছেন ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, স্পেন, ব্রাজিল, ভেনেজুয়েলা, বেলজিয়াম, মরিশাস, মেক্সিকো, লেসেথো, আলবেনিয়া ও পাপুয়া নিউ গিনি থেকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তিনজন কার্ডিনাল হয়েছেন, ইতালি থেকে হয়েছেন দুজন।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের জন্য ইসলাম দায়ী নয়
বেনারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেন, “আমাদের পোপ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের জন্য ইসলাম দায়ী নয়। মাস কয়েক আগে ধারাবাহিক জঙ্গি হামলার ঘটনা বাদ দিলে এ দেশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায় যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছে।”
তাঁর মতে, “বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদ সৃষ্টির কারণ এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। এখানকার শিক্ষাব্যবস্থায় পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা শেখাতে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা হয় না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি এ বিষয়টি জানিয়েছি।”
“সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মৃত্যুদণ্ড চেয়ে রাস্তায় মিছিল করে। এটা দেখে আমি মর্মাহত। মৃত্যুদণ্ড শিশুদের মধ্যে নৃশংস মনোভাব তৈরি করে। তাদের উচিত মৃত্যুদণ্ড না চেয়ে বিচার দাবি করা,” জানান প্যাট্রিক ডি রোজারিও।
তিনি বলেন, ক্যাথলিক মূল্যবোধ পরিবারকে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে রক্ষা করে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া তরুণেরা পরিবার ত্যাগ করেছে। এর কারণ শিক্ষায় গলদ ও পারিবারিক মূল্যবোধের ঘাটতি।
তিনি আরও বলেন, “এ দেশের খুবই কম সংখ্যক মানুষ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের মাধ্যমে আন্তধর্মীয় সম্পর্ক বিনষ্ট করতে চায়। তবে আমি মনেকরি, বাংলাদেশ আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতির চোখ ধাঁধানো দৃষ্টান্ত হতে পারে।”
বাংলাদেশের মিশনারি স্কুলগুলোতে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিভিন্ন ধর্মের এবং এসব স্কুল সুনাম অর্জন করেছে বলেও জানান প্যাট্রিক ডি রোজারিও।
তিনি বলেন, প্রায় সব অভিভাবকই তার সন্তানকে মিশনারি স্কুলে ভর্তি করতে চায়। এসব স্কুলে শিশুদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মানবিকতা ও সহনশীলতা শেখানো হয়।
দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন, ঢাকার নটর ডেম কলেজে অর্ধেক শিক্ষার্থীকে গ্রাম এলাকা থেকে নেওয়া হয়। এ ছাড়া আদিবাসী সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মিশ্রণ সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ তৈরি করতে সহায়তা করে।
প্যাট্রিক ডি রোজারিওর অতীত
প্যাট্রিক ডি রোজারিও ১৯৪৩ সালে বরিশালের পাদ্রি শিবপুরে জন্ম নেন। ৭৩ বছর বয়সী প্যাট্রিক ডি রোজারিও ১৯৭২ সালে ফাদার বা যাজক হয়েছিলেন।
যাজক হিসেবে ১৮ বছর দায়িত্ব পালনের পর তৎকালীন ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রধান পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট ১৯৯০ সালে তাঁকে বাংলাদেশের আর্চবিশপ হিসেবে মনোনীত করেছিলেন। বিশপ নির্বাচিত হবার পর তিনি রাজশাহীতে ধর্ম প্রদেশের দায়িত্ব নেন। ২০১১ সালে ঢাকার আর্চবিশপ বা বাংলাদেশে ক্যাথলিকদের প্রধান ধর্মগুরুর দায়িত্ব পান।
পোপ ষোড়শ বেনেডিক্টের কাছ থেকে পলিউম সম্মাননাও তিনি নিয়েছিলেন, যা ক্যাথলিক যাজকদের সর্বোচ্চ সম্মাননা।
অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা
কার্ডিনাল মনোনীত হওয়ায় প্যাট্রিক ডি রোজারিওকে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠন অভিনন্দন জানিয়েছে। খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য পোপের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও বেনারকে বলেন, বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস শুধু ইউরোপ বা আমেরিকা নয়, এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোকেও যে গুরুত্ব দিচ্ছেন, বাংলাদেশ থেকে কার্ডিনাল বাছাই করা তার একটি উদাহরণ।
প্যাট্রিক ডি রোজারিওকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বিরোধী দল বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, “আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিওকে কার্ডিনাল ঘোষণা করায় আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। তিনি আমাদের দেশের জন্য এক অনন্য সম্মান ও মর্যাদা বয়ে এনেছেন।”
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বেনারকে বলেন, “এই সম্মান ও মর্যাদা কেবল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নয়, এটা গোটা দেশের অর্জন। আমরা ওনাকে অভিনন্দন জানাই।”
উল্লেখ্য, পোপ বেনডিক্ট আগামী বছর বাংলাদেশ সফরের কথা রয়েছে। এটা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসার নিদর্শন বলে জানান খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতারা।