সাঁড়াশি অভিযানের প্রথম দিনেই সেবাশ্রমের সেবক হত্যা
2016.06.10
এবার পাবনায় শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের সেবক নিত্যরঞ্জন পান্ডেকে (৬২) কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। দেশের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এই হত্যার মিল দেখছে পুলিশ।
শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে পাবনা মানসিক হাসপাতালের প্রধান ফটকের সামনে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। নিত্যরঞ্জন হাঁটতে বের হওয়ার পর ওঁৎ পেতে থাকা দুর্বৃত্তরা তাঁকে জবাই করে হত্যা করে।
গত প্রায় দেড় বছরে একই ধরণের ঘটনায় নিহত হলেন নিত্যরঞ্জনসহ ৫১ ব্যক্তি। প্রতিটি ঘটনার পর মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট–আইএস বা আল কায়েদা দায় স্বীকার করে আসছে।
যদিও সরকার বলে আসছে, বিদেশি কোনও জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব নেই দেশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে বিরোধী দল বিএনপি–জামায়াত জড়িত বলে ইঙ্গিত দেন।
হত্যাকাণ্ডের ধরন দেখে পুলিশ বলছে, নিত্যরঞ্জন পাণ্ডেকে পেছন থেকে ঘাড়ে কোপ দেওয়া হয়। ঘাড়ে ও মাথায় এমনভাবে কোপানো হয়েছে যা দেখে মনে হয় খুনিরা তাঁর শরীর থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চেয়েছিল।
পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল্লাহ আল হাসান টেলিফোনে বেনারকে বলেন, “কী কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।”
দেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটে পুলিশ দেশজুড়ে জঙ্গি দমনে সাত দিনের ‘সাঁড়াশি অভিযান’ শুরু করেছে গতকাল থেকে। কিন্তু দিনের শুরুতেই পাবনার হেমায়েতপুরে খুন হলেন নিত্যরঞ্জন।
নিহত ব্যক্তি সৎসঙ্গ আশ্রম নামে পরিচিত ওই সেবাশ্রমে কাজ করে আসছিলেন গত ৪০ বছর ধরে। তাঁর বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলা সদরে। তাঁর বাবার নাম রশিক লাল পান্ডে।
গত ৭ জুন ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী, ৫ জুন নাটোরে খ্রিস্টান দোকানি সুনীল গোমেজ এবং একই দিনে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা আক্তার মিতু হত্যার সঙ্গে গতকালের এই হত্যাকাণ্ডের মিল রয়েছে।
আশ্রমের নির্বাহী পরিষদের সদস্য বলাই কৃষ্ণ সাহা বেনারকে জানান, “তাঁর ঘাড় ও মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। খবর পেয়ে আশ্রমের লোকজন ঘটনাস্থলে যায়। পরে পুলিশ গিয়ে লাশ উদ্ধার করে।” “এ ঘটনায় আমরা আতংকিত। আমরা সরকারের কাছে নিরাপত্তা চাই,” জানান বলাই কৃষ্ণ।
এই হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু কারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য তারা দিতে পারেননি। স্থানীয় সাংবাদিকদের তারা বলেছেন, তদন্তে জানা যাবে কারা এটি ঘটিয়েছে।
এ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি এএসপি সেলিম খান। বিভিন্ন জেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রতিক হামলার মত নিত্যরঞ্জন হত্যার পেছনেও জঙ্গিদের হাত থাকতে পারে বলে তার সন্দেহ।
হত্যাকাণ্ডের পর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লিটন কুমার দাসকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত দল গঠন করেছে পুলিশ প্রশাসন।
গোপালগঞ্জ সদরের আড়ুয়া কংশুর গ্রামে নিত্যরঞ্জনের বাড়ি। সেখানে রয়েছে তার স্ত্রী দুলু রানী, ছেলে নন্দ দুলাল, দুই মেয়ে নন্দিতা ও সন্দিপা পাণ্ডেসহ বহু স্বজন-শুভাকাঙ্ক্ষী। সকালে গোপালগঞ্জে তাঁর বাড়িতে মৃত্যুর খরব পৌঁছার পরই স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। ছুটে আসেন গ্রামবাসী।
নিত্যরঞ্জনের বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সত্যরঞ্জন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, “নিত্য প্রথমদিকে ওই আশ্রমের অফিসে কাজ করতেন। তারপর ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের আদর্শ প্রচার শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের আনুসারীদের দীক্ষা দিতেন।”
তিনি জানান, তাঁর ভাইয়ের কোনও শত্রু ছিল না।
হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গতকাল পাবনা শহরে মানববন্ধন হয়েছে। হত্যাকারী দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে মানববন্ধনে বলা হয়, সৎসঙ্গ সেবাশ্রমের প্রায় শতাধিক সেবক চরম নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন।
এদিকে ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় গতকাল দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি সেবাশ্রমের কর্মকর্তা ও নিহত নিত্যরঞ্জন পান্ডের শ্বাশুড়িসহ স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন।