ঈদের পরদিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন ১৩ জন
2016.09.14

ঈদুল আজহার পরদিনই রাজধানী ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ নিহত হয়েছেন অন্তত ১৩ জন। আহতের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক।
প্রতি বছরই ঈদ উপলক্ষে ঘরমুখো মানুষের যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় সড়ক দুর্ঘটনাও বেড়ে যায়। তবে এবার ঈদ পূর্ব যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। কিন্তু ঈদের পরদিনই তা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়।
সড়কের বেহাল দশা, বিকল্প পথের অভাব, বৈরী আবহাওয়া, যাত্রীদের অসচেতনতা, চালকদের অদক্ষতা এবং পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবেই এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনেকরেন বিশেষজ্ঞরা।
গতকাল বুধবার ঈদুল আজহার ছুটি শেষ হয়েছে। গ্রামে ফেরা লোকজন জীবিকার তাগিদে আবারও ছুটছে শহরে, বিশেষ করে ঢাকায়। এসময় সড়ক–মহাসড়কগুলোর উপর চাপ বাড়ে, যা অব্যহত থাকে কয়েকদিন।
গত মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের ছয়টি জেলা ও মহানগরে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় প্রাইভেট কারের ধাক্কায় এক বৃদ্ধ দম্পতি, দিনাজপুরে বাস উল্টে নারী-শিশুসহ চারজন, ঠাকুরগাঁওয়ে পিকআপ ভ্যান ও মিনিবাসের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। এ ছাড়া ঝালকাঠি জেলায় এক কিশোর, সিরাজগঞ্জে এক পুলিশ কনস্টেবল ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে দুই জন নিহত হয়েছেন।
দিনাজপুর কোতোয়ালি থানার ওসি রেদওয়ানুর রহিম সাংবাদিকদের জানান, বুধবার দুপুর ২টার দিকে দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়কে বাস উল্টে ঘটনাস্থলেই দুজন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর শিশুসহ আরো একজনের মৃত্যু হয়।
তিনি আরো জানান, এই দুর্ঘটনায় আহত হন ৪৫ জন।এ মধ্যে ৩৩ জনকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাকিরা প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
এদিন ঠাকুরগাঁও-ঢাকা মহাসড়কে পিকআপ ভ্যান ও মিনিবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক নারীসহ তিনজন নিহত হন বলে সাংবাদিকদের জানান সদর থানার এসআই আবু হানিফ।
সন্তানের কাছে যাওয়া হলো না বৃদ্ধ দম্পতির
ঈদ উপলক্ষে মেয়ের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য বুধবার ভোরে বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন আতাউর রহমান (৭০) ও তাঁর স্ত্রী রওশন আরা (৬০)। কিন্তু দ্রুত গতিতে আসা একটি প্রাইভেট কারের ধাক্কায় রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডেই প্রাণ হারান ওই দম্পতি। এ সময় আহত হন এক দোকানদার।
কাফরুল থানার ওসি শিকদার শামীম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “দ্রুতগতির একটি প্রাইভেট কারের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই ওই দম্পতির মৃত্যু হয়। গাড়িটি আটক করা হয়েছে। তবে চালক পালিয়ে গেছে।”
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কামারুজ্জামান নামে এক পথচারী বেনারকে জানান, “একদল তরুণ মাতাল অবস্থায় দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধ দম্পতিকে ধাক্কা দেয়। ওই গাড়িতে স্থানীয় একজন পানের দোকানদারও আহত হন।”
ঈদের পরদিন মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল
চট্টগ্রামের দামপাড়া এলাকায় একটি প্রাডো গাড়ির ধাক্কায় নিহত হয়েছেন রিকশারোহী আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জাহিন ফায়াজ হক (২১)। আহত হয় তাঁর দুই বন্ধুসহ রিকশা চালকও। নিহতের বাবা-মা বর্তমানে সৌদি আরবে হজ্জ পালন করছেন।
এ ঘটনায় চালকসহ গাড়িটিকে আটক করা হয়েছে বলে জানান চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নুরুল হুদা।
নিহত জাহিনের একজন আত্মীয় ইমরান আলম বেনারকে বলেন, “ওই ড্রাইভারকে পাশে বসিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল এক তরুণ। পুলিশ ওই তরুণকে আটক করেছে”। এ ঘটনায় নিহতের খালা একটি মামলা করেছেন বলে জানায় পুলিশ।
গতকাল সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মিনিবাস ও ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত হন পলিমা গাঢ় (৩০) ও সমলাল চন্দ্র পাল (৪০) নামে আরো দুজন।
এ ছাড়া ঝালকাঠি-বরিশাল সড়কে বাসের ধাক্কায় নিহত হয়েছে মেহেদি হাসান (১৩) নামের এক কিশোর। এতে আহত হয় তার মা-বাবা ও বোনসহ আরো চারজন।
সিরাজগঞ্জ-নগরবাড়ি মহাসড়কে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান পুলিশ কনস্টেবল আবু মুসা (৩৫)। উল্লাপাড়া থানার ওসি দেওয়ান কৌশিক আহম্মেদ সাংবাদিকেদর জানান, ঈদের ছুটি শেষে গ্রামের বাড়ি থেকে মোটরসাইকেলে করে সিরাজগঞ্জে কর্মস্থলে ফেরার পথে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি গাড়ির ধাক্কায় গুরুতর আহত হন তিনি। স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।
ব্যবস্থাপনার অভাবই বড় কারণ
ঘরমুখো মানুষের ঈদ যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে ঈদের আগের থেকেই দাবি করে আসছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু সেই চিত্র সর্বত্র দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঈদ উপলক্ষে রাজধানীসহ প্রধান প্রধান শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ শহর ছাড়ে। এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি না থাকায় জনদুর্ভোগ ছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়।
এ বিষয়ে চলচ্চিত্র অভিনেতা ও নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বেনারকে বলেন, “অন্যান্য বছর সরকারের তরফ থেকে যেভাবে ঈদ যাত্রার ব্যবস্থাপনা হয়, এবার সেটির অভাব ছিল। দেশের দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা ঢাকা–আরিচা মহাসড়ক প্রায় অবরুদ্ধ ছিল, ফেরিঘাটে ছিল অসহনীয় অবস্থা। ফলে দক্ষিণবঙ্গের বিকল্প ঢাকা–মাওয়া সড়কে অনেক বেশি চাপ পড়েছে।”
তাঁর মতে “শত শত কোটি অর্থ খরচ করে ঈদুল ফিতরের আগে সড়ক মেরামত করা হয়। মাত্র আড়াই মাস পরে আরেকটি ঈদ হলেও ইতিমধ্যে সেসব রাস্তা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া গাড়িগুলোর দ্রুত গতির ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি নেই।”