উপমহাদেশের তিন দেশের বিরোধের জের ধরে সার্ক সম্মেলন স্থগিত

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.09.28
20160928-Saarc-Summit1000.jpg নেপালের কাঠমান্ডুতে ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নেতারা। ২৭ নভেম্বর ২০১৪।
সার্ক সচিবালয়

পাকিস্তানের ইসলামাবাদে সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছে না বাংলাদেশ। একই সিদ্ধান্ত জানিয়েছে ভারত, আফগানিস্তান ও ভুটান। ফলে স্থগিত হয়ে গেল আগামী ৯ ও ১০ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় আট সদস্যের এই জোটের ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন।

মূলতঃ উপমহাদেশের তিন দেশ বাংলাদেশ-পাকিস্তান ও পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার বিরোধের জের ধরেই সম্মেলনটি স্থগিত হয়েছে।

এর ফলে দক্ষিণ এশীয় এই আঞ্চলিক জোটটি আবারও সংকটের মুখে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সংকট কাটাতে সদস্য দেশগুলোকেই এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তাঁরা।

সার্ক সনদ অনুযায়ী কোনও একটি সদস্য দেশ যদি সম্মেলনে অংশ না নেয় তবে স্বয়ক্রিয়ভাবেই সম্মেলন স্থগিত বা বাতিল হয়ে যায়।

সার্কের বর্তমান সভাপতি নেপাল ১৯তম শীর্ষ সম্মেলন স্থগিত করেছে। নেপালের সংবাদমাধ্যমগুলো এই খবর প্রকাশ করেছে। যদিও এখন পর্যন্ত নেপাল এবং আয়োজক দেশ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন স্থগিত করার ঘোষণা আসেনি।

তবে ইসলামাবাদে সম্মেলন আয়োজনকে ঘিরে চার সদস্য দেশের আপত্তির কথা মাথায় রেখে নেপাল নতুন ভেন্যু খুঁজছে বলেও জানিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যম।

পাকিস্তানের হস্তক্ষেপই কারণ

বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে পাকিস্তানের অব্যাহত হস্তক্ষেপের কারণেই ইসলামাবাদে প্রস্তাবিত সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।

এ বিষয়ে বুধবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ যোগ দিচ্ছে না। এটা জানিয়ে মঙ্গলবার সার্কের সভাপতি দেশ নেপাল ও সার্ক সচিবালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

কারণ হিসেবে ওই চিঠিতে বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রতিবেশি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি রাষ্ট্রের টানা হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়।

বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে অন্য কোনো রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের কোনো সম্পর্ক নেই জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বেনারকে বলেন, “এটা বাংলাদেশের নিজস্ব সিদ্ধান্ত।”

“তবে সার্কের প্রতিষ্ঠাতা দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতা, কানেকটিভিটি ও সার্বিক সহযোগিতার বিষয়ে বিশ্বাস করে। সময় ও সুযোগ যখন আসবে বাংলাদেশ তখন সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেবে,” জানান শাহরিয়ার।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও এদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নিয়ে শুরু থেকেই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে পাকিস্তান।

বারবার সতর্ক করলেও সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীর ফাঁসির পরে শোক জানিয়ে বিবৃতি দেয় পাকিস্তান সরকার। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দেশটির রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। যুদ্ধাপরাধের বিচারের নিয়ে পাকিস্তানের বিবৃতি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল বলেই জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ।

এদিকে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি দেশের হস্তক্ষেপের কারণ দেখিয়ে ভারতও এবারের সার্ক সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, “সার্কের বর্তমান সভাপতি নেপালকে জানানো হয়েছে, এই অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী হামলা এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে একটি দেশের হস্তক্ষেপের ফলে এমন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে, যা আগামী নভেম্বরে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠেয় ১৯তম সার্ক সম্মেলনে যোগদানের পক্ষে সহায়ক নয়।”

উল্লেখ্য, চলতি মাসের ১৮ তারিখে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের সেনা ঘাঁটিতে হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে ভারত। এ নিয়ে দুদেশের সম্পর্ক চরমে পৌঁছেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতেই পাকিস্তানের নাম উল্লেখ না করে উপরোক্ত বিবৃতি দিয়েছে ভারত।

এদিকে আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাওয়ার কারণে সার্ক সম্মেলন সফলভাবে করার মতো পরিবেশ নেই মর্মে শংকা প্রকাশ করে সম্মেলন বর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে ভুটান।

এছাড়া আফগানিস্তান জানিয়েছে, দেশটিতে আরোপিত সন্ত্রাসবাদের কারণে সহিংসতা ও লড়াইয়ের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি এবং কমান্ডার ইন চিফকে সে পরিস্থিতি মোকাবেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। এ কারণে সম্মেলনে যোগ দিতে না পারার কথা জানায় পাকিস্তানের প্রতিবেশি ওই দেশটিও।

এদিকে চার সদস্য রাষ্ট্রের সার্ক সম্মেলনে যোগ না দেওয়াকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলছে পাকিস্তান।

এ বিষয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার টুইট উদ্ধৃত করে দেশটির জাতীয় দৈনিক ডন লিখেছে, “যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কিছু জানানো হয়নি। তবুও বিষয়টি অনাকাঙ্ক্ষিত। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও শান্তি রক্ষায় পাকিস্তান অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ অঞ্চলের মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাব আমরা।”

সার্কের অন্য সদস্য দেশগুলো হলো; শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ। এখন পর্যন্ত ওই দুটি দেশ সম্মেলন নিয়ে কোনো মত প্রকাশ করেনি।

সংকটে সার্ক

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালে সার্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। তবে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ব্যর্থতায় বারবার সংকটে পড়ে দীর্ঘ ৩০ বছরেও সে লক্ষ্য পূরণ হয়নি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এবারের সার্ক সম্মেলন স্থগিত হয়ে যাওয়ার ফলে আবারও সার্ক গভীর সংকটে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করেন তাঁরা।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. দেলোয়ার হোসেন বেনারকে জানান, “দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অবনতিশীল অবস্থায় থাকলে আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগ কম থাকে।”

তিনি বলেন, “সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অসহযোগিতার কারণেই সার্কের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। এবারও সার্ক একটা সংকটের মধ্যে পড়েছে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোকেই সে সংকট থেকে সার্ককে বের করে আনতে হবে।”

তবে তাঁর মতে, “এখন সার্কের ভবিষ্যতের চেয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে একাধিক রাষ্ট্রের বিরোধের কারণে যে আঞ্চলিক অশান্তি বা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।