লাঞ্ছিত শিক্ষকের পাশে উচ্চ আদালত, দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড়

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.05.18
School-Teache-Humiliated620.jpg নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে উঠবস করানোর প্রতিবাদে সিলেটের হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে নিজেদের কান ধরে অভিনব প্রতিবাদ করেন। মে ১৭, ২০১৬।
ফোকাস বাংলা

দেশজুড়ে সমালোচনা ও প্রতিবাদের পর অবশেষে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালো নারায়ণগঞ্জের এক স্কুল শিক্ষককে কান ধরিয়ে উঠবস করানোর ঘটনা। সাংসদ সেলিম ওসমানসহ ওই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না—তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছে  বাংলাদেশের উচ্চ আদালত।

আগামী তিন দিনের মধ্যে দোষীদের বিরুদ্ধে কী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিল করতে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বুধবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।

দুই সপ্তাহের মধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব, আইন সচিব, নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, বন্দরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিসহ বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে কটুক্তি করার কথিত অভিযোগে নারায়ণগঞ্জে পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে গত শুক্রবার কান ধরে উঠবস করানো হয়। স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানের নেতৃত্বে ঘটনাটি ঘটে। এর আগে এলাকাবাসী ওই শিক্ষককে মারধর করে।

তবে সে অভিযোগ অস্বীকার করে শ্যামল কান্তি বলে আসছেন, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সঙ্গে বিরোধের জের থেকে তাঁর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ধর্ম অবমাননার এই অভিযোগ আনা হয়েছে।

দশম শ্রেণির যে ছাত্রটির মাধ্যমে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেও গত দুদিন সাংবাদিকদের বলেছে, ওই শিক্ষক ইসলাম ধর্ম নিয়ে কিছু বলেননি। তবে শিক্ষক তাকে মারধর করেছিলেন এবং পরে দুঃখ প্রকাশও করেছেন।

ওই শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার পর থেকেই দোষীদের বিচার দাবিতে দেশজুড়ে প্রতিবাদ চলছে। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও বারবার দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। তবে এরই মধ্যে মঙ্গলবার ওই শিক্ষককে স্কুল কর্তৃপক্ষ চাকরিচ্যুত করায় ক্ষোভ, সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।

বিচারিক বিবেককে নাড়া দিয়েছে: হাইকোর্ট

বুধবার দুপুরে শিক্ষক লাঞ্ছনার ওই ঘটনায় দেশের বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান ও মহসীন রশিদ। তাঁদের সঙ্গে আইনজীবী সোয়েব আহমেদ ও ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজীম শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন।

আদালতের দেওয়া আদেশে বলা হয়, “ওই অমানবিক ও নিগ্রহজনক ঘটনা আমাদের বিচারিক বিবেকে নাড়া দিয়েছে। সংবিধানের অভিভাবক সুপ্রিম কোর্ট। অভিভাবক হিসেবে আমরা চোখ বন্ধ করে থাকতে পারি না।”

আগামী ২৯ মে বিষয়টি আবারও আদালতের কার্যতালিকায় আসবে বলে জানান আদালত।

সংবিধান লঙ্ঘণ

শিক্ষককে উঠবস করানোর ঘটনাকে ‘অপরাধ’ হিসেবে গণ্য করেছেন আদালত। আদালত বলেছেন, এ ধরনের ঘটনা কারও কাছেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান বেনারকে বলেন, “সংবিধান অনুযায়ী এ রকম শাস্তি দেশের কোনো নাগরিককেই জনসম্মুখে দেওয়া যায় না। সংবিধানের ৩৫(৫) ও ১১ অনুচ্ছেদে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নিষেধ করা হয়েছে। যারা শিক্ষক শ্যামল কান্তির সঙ্গে এ আচরণ করেছেন তারা সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন।”

এদিকে শুরু থেকেই শিক্ষক লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ওই ঘটনাকে ‘কলঙ্কজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন। বুধবার তিনি বলেন, “তদন্ত প্রতিবেদন পেলেই দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ক্ষমা চেয়ে পুনর্বহালের দাবি

এদিকে শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে উঠবস করানোর এ ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সামাজিক গণমাধ্যমও সরব ।বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এক বিৃবতিতে সাংসদ সেলিম ওসমানসহ জড়িত অন্যদের ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

মঙ্গলবার সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, ওই শিক্ষককে লাঞ্ছনা করে সেলিম ওসমান সংসদ সদস্য পদের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করেছেন। ওই শিক্ষককে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিও জানায় ১৪ দল।

এদিকে এক অভিনব প্রতিবাদে মুখর হতে দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ব্যবহারকারীদের। কেউ ‘সরি স্যার’ লেখার সঙ্গে কান ধরে তোলা ছবি দিয়ে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও ঘটনার নিন্দা জানিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, “নারায়ণগঞ্জে শিক্ষককে অপমান করার তীব্র নিন্দা জানাই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। আশা করি তা দ্রুত করা হবে।”

এ ঘটনাকে শুধু শিক্ষককে অপমান করা হিসেবে দেখছেন না কেউ কেউ। তাদের মতে, এর মাধ্যমে নাগরিক অধিকার লাঞ্ছিত করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক আলী রিয়াজ বেনারকে বলেন, “শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্থানীয় সাংসদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে মারধর ও কান ধরে উঠবস করানোর এই ঘটনা মানবিক মর্যাদার অবমাননা, নাগরিকের অধিকার লাঞ্ছনা। ”

তিনি বলেন, “শিক্ষক হিসেবেই কেবল শ্যামল কান্তি ভক্ত মানবিক মর্যাদার দাবিদার নয়, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এই মর্যাদার দাবিদার তিনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র তাঁকে সেই অধিকার দিয়েছে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।