ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকা উত্তরায় তাঁর বসবাস। কিন্তু একটি কার্ড পেয়ে তিনি নিজেকে স্মার্ট নাগরিক মনে করছেন। কার্ডটির নামও স্মার্ট কার্ড, যা নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গেছে।
“এতদিন উন্নত দেশে এমন কার্ডের কথা শুনেছি। এখন আমার হাতে এ ধরনের কার্ড। এর মাধ্যমে অনেকগুলো নাগরিক সেবা পাওয়া যাবে,” বেনারকে জানান রাজধানীর উত্তরা এলাকার বাসিন্দা শামীমা রহমান (৩৮), যিনি একটি বেসরকারি সংস্থার মাঠ কর্মকর্তা।
স্মার্ট কার্ড হাতে পেয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নাগরিক শামীমার মতো বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রথম সব নাগরিকের জন্য চালু হয় জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্টকার্ড হবে এর উন্নত সংস্করণ।
সরকার বলছে, একটি স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে একজন নাগরিক ২২টি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে পারবেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে প্রথম স্মার্টকার্ড পান কাকরাইলের ভোটার সাহানা আক্তার খানম, যার হাসিমাখা ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।
গত ২ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের হাতে কার্ড তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়েরা স্মার্টকার্ড নেন।
“স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের অপরাধীকে শনাক্ত করা সহজ হবে। এ ছাড়া প্রতারণা ও জালিয়াতিও কমে আসবে,” উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন প্রধানমন্ত্রী।
নির্বাচন কমিশন বলছে, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এবার নাগরিকদের জন্য উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা স্মার্টকার্ড চালু করেছে সরকার। কমিশন বলছে, প্রথম দফায় দেশের নয় কোটি ভোটার এই কার্ড পাবেন। এ জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা।
প্রতিটি কার্ড বিতরণে ব্যয় হবে নয় টাকার বেশি। এ ছাড়া ১০ বছর মেয়াদি এই স্মার্টকার্ড তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ২ ডলার করে, যা প্রায় ১৬০ টাকা।
পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া প্রাথমিক পর্যায়ের এ কাজ শেষ হলে আগামী নভেম্বরে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন ও ফুলবাড়ী উপজেলায় কার্ড বিতরণ করবে কমিশন। এরপর অন্য সিটি কর্পোরেশন, জেলা ও উপজেলায় পর্যায়ক্রমে উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র সরবরাহ করা হবে।
বাংলাদেশের গ্রিন কার্ড !
স্মার্ট কার্ডকে বলা হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রিন কার্ড! গ্রিন কার্ড ছাড়া যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক সেবা পাওয়া যায় না, ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও তেমনটি হতে যাচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্ডে তথ্যের সঙ্গে চোখের মণির ছবি এবং হাতের সব আঙুলের ছাপ সংরক্ষিত থাকবে, যা অপরাধী শনাক্ত কাজ সহজ করবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে ২০১১ সালে উন্নতমানের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় একটি প্রকল্প হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন।
এ কার্ড প্রসঙ্গে সিইসি শামসুল হুদা বেনারকে বলেন, “তিন স্তরের ২৫টি নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্লাস্টিকের নতুন স্মার্ট কার্ড সহজে নকল করা যাবে না। এতে পরিচয়পত্রধারীর আইডি নম্বর ঠিকানাসহ বিভিন্ন তথ্য এই সংরক্ষিত থাকবে।”
আছে ভোগান্তিও
কাঙ্ক্ষিত এ স্মার্টকার্ড পেতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন অনেকেই। প্রথম পর্যায়ে বর্তমানে ৯ কোটি ভোটারের স্মার্টকার্ড ছাপানো ও বিতরণের কাজ চলছে।
নির্বাচন কমিশনের ভান্ডারে জাতীয় পরিচয়পত্রের সম্পূর্ণ তথ্য না থাকায় এক কোটির বেশি ভোটার এ দফায় স্মার্টকার্ড পাচ্ছেন না, যাদের পুনরায় তথ্য ফরম পূরণ করতে হবে।
২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে হওয়া ভোটারদের নয় ভাগের এক ভাগের বেশি ভোটারের তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে ২৩ ধরনের তথ্য ইসির নির্ধারিত ফর্মে লিপিবদ্ধ করতে হয়। এর মধ্যে অন্তত ১৮ ধরনের তথ্য না থাকলে স্মার্টকার্ড প্রিন্ট করা হবে না।
আবার পুরোনো কার্ডে যাদের নিম্নমানের ছবি এসেছে এবং আঙুলের ছাপ আশানুরূপ না তারাও এ সমস্যায় পড়েছেন। এসব কারণে যারা স্মার্টকার্ড পাচ্ছেন না, তাদের আইডি নম্বর, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর সংরক্ষণ করছে কমিশন। পরবর্তীতে তাদের সমস্যার সমাধান করা হবে।
অনেকেই ভোটার এলাকা পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছেন, যাদের এলাকা পরিবর্তন হয়নি বা পরিবর্তন হয়েছে, তারাও কার্ড পাচ্ছেন না।
এ ছাড়াও ২০১৫ সালের ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি যাদের ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি, তারা কার্ড পাবেন না।
যাদের পুরোনো লেমিনেটিং করা এনআইডি কার্ড হারিয়ে গেছে—এমন অনেকেই কার্ড না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। জিডির (সাধারণ ডায়েরি) কপি নয়, কেবল ফের কার্ড তুলে ক্যাম্পে জমা দিলেই স্মার্টকার্ড পাওয়া যাবে। স্ক্যান কপি প্রিন্ট করিয়ে ডুপ্লিকেট কার্ডও গ্রহণ করা হবে না।
ইসির স্মার্ট এনআইডি প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন বেনারকে জানান, “২০১৭ সালের মধ্যে সব নাগরিকের হাতে স্মার্ট কার্ড তুলে দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছি। শুরুর দিকে কিছুটা সমস্যা দেখা দিলেও খুব শিগগির তা কেটে যাবে।”