দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় এক ধাপ এগোলেও সূচক অপরিবর্তিত

শরীফ খিয়াম
2020.01.23
ঢাকা
200123_Corruption_1000.jpg দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, পাশে রয়েছেন সংস্থার চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল। ২৩ জানুয়ারি ২০২০।
[শরীফ খিয়াম/বেনারনিউজ]

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘শূন্য সহনশীল’ অবস্থানের কারণে বৈশ্বিক মাপকাঠিতে অবস্থানগত উন্নতি হলেও বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক। করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স (সিপিআই) বা দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০১৯ প্রকাশকালে এমনটা দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

এবার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম, গত বছরে ছিল ১৩।

এবার কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের ক্রম তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম, আগের বছর ছিল ১৪৯ নম্বরে। অর্থাৎ শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্তদের ক্রম তালিকায় এক ধাপ এবং কম দুর্নীতিগ্রস্তদের তালিকায় তিন ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ।

বৃহস্পতিবার বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) সারা বিশ্বে একযোগে দুর্নীতির ধারণা সূচক-২০১৯ প্রকাশ করেছে। ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের ওপর এই সূচক তৈরি করা হয়। এর অংশ হিসেবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ঢাকার ধানমন্ডিতে সংস্থার কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতি সূচকের নানা দিক তুলে ধরে।

এবারের দুর্নীতি সূচকে ১০০–এর মধ্যে বাংলাদেশ ২৬ স্কোর করেছে। ২০১৮ সালেও বাংলাদেশের স্কোর ছিল ২৬। অর্থাৎ সূচকে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণাটা যতটা সময়োপযোগী বা সহজভাবে বলে দেওয়ার মতো একটি বিষয়, ততটাই কঠিন ও জটিল হচ্ছে এটাকে সত্যিকার অর্থে প্রয়োগ করা।”

তবে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ বেনারকে বলেন, “টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর মাত্র এক বছর সময় পার হয়েছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় দুর্নীতির বিরোধী যে অভিযান শুরু হয়েছে, তার সুফল পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।”

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারের ২১টি অঙ্গীকারের মধ্যেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার কথা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এটাই স্বীকৃতি দেয় যে আমরা জানি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে দুর্নীতি।”

“আমরা সমস্যাটিকে ধামাচাপা না দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করছি,” বলেন ফরহাদ।

এ প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বেনারকে বলেন, “শূন্য সহনশীলতার কথা বললেই শুধু হবে না, এর কার্যকারিতাও থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর চারপাশেই বড় বড় দুর্নীতিবাজরা ঘুরঘুর করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে বুঝতাম শূন্য সহনশীলতা জারি রয়েছে।”

“কমেছে কোথায়? বরং দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। কমার কোনো লক্ষণ নেই বরং, দিনদিনই প্রকোপ বাড়ছে,” যোগ করেন তিনি।

এদিকে গত বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরায় দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ক এক সভায় দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, “আমরা উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। দুর্নীতিবাজরাও এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা না করলে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।”

‘অগ্রগতি হয়নি’ বাংলাদেশের

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি জানায়, ১০০ নম্বরের মানদণ্ডে টানা দুই বছর ধরে (২০১৯ ও ২০১৮) বাংলাদেশের স্কোর ২৬। যে সময়ে (ডিসেম্বর-২০১৭ থেকে অক্টোবর-২০১৯) এবারের সূচকের তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে, সেই মেয়াদ নিয়ে সংস্থাটির একটি উচ্চ প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল।

“২০১৭ সালের শেষের দিক থেকেই প্রধানমন্ত্রীর মুখে বারবার বেশ জোরালোভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার কথা শোনা গেছে। গত নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণার সময় থেকে শুরু করে প্রায় দেড় বছর ধরে তিনি বারবার এটার পুনরাবৃত্তি করছেন,” বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

তাঁর দাবি, এটা এক অন্য মাত্রা পেয়েছিল যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরেশোরে অভিযান শুরু করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। নিজ দলের নেতা-কর্মীসহ সবাইকে বিচারের আওতায় আনবেন।

“প্রধানমন্ত্রীর এমন ঘোষণার ইতিবাচক প্রভাবেই হয়তো আমাদের স্কোর কমেনি, কিন্তু অগ্রগতিও তেমন হয়নি। তবে তাঁর নির্দেশনা যদি সঠিকভাবে প্রতিপালিত হতো, তাহলে আমাদের স্কোর ৪৩ (গড় স্কোরের) এর নিচে থাকত না,” বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তাঁর মতে, সামান্য যে অগ্রগতি তাতে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ফরহাদ বলেন, “এই সব ‘ইনডেক্স’ (সূচক) মূলত ‘পারসেপশনের’ (ধারণা) ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রে ‘পারসেপশন’ বদলাতে একটু সময় লাগবে।”

“গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে যেভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলছে, তাঁর প্রভাব হয়তো আমরা পরবর্তী সূচকেই দেখতে পাব,” বলেন আওয়ামী লীগের গবেষণা শাখা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) এই জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক।

বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত টানা পাঁচ বছর সর্বনিম্ন স্কোর পেয়ে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “২০০৬ থেকে আমাদের ক্রমাগত উন্নতি হয়েছে। কিন্তু স্কোর ২০ কোঠাতেই রয়ে গেছে।”

“যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে সেটিকে প্রয়োগ করে প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতি বিরোধী ঘোষণাকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) সৎ সাহস ও দৃঢ়তা দেখাতে হবে,” যোগ করেন তিনি।

টিআইবি বলছে, জবাবদিহি নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসহ যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের পেশাগত উৎকর্ষ, শুদ্ধাচার এবং নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা ও বজায় রাখার জন্য রাজনৈতিক প্রভাব তুলে নিতে হবে।

ধরা পড়ছে না ‘বিগফিস’

ইফতেখারুজ্জামানের দাবি, যাদের বিরুদ্ধে বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ, বিশেষ করে যারা ক্ষমতাবান ‘বিগ-ফিস’; বা রুই-কাতলা বলা হয় যাদের; মন্ত্রীদের দৃষ্টিতেও যারা ‘গডফাদার’, তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে বা যাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা বা প্রশ্ন রয়ে গেছে জনমনে।

“যে মেয়াদের কথা এই সূচকে বলা হয়েছে, সেই মেয়াদে দুদককে তুলনামূলকভাবে সক্রিয় দেখা গেলেও তা সীমাবদ্ধ থেকেছে নিম্ন থেকে মধ্যম পর্যায়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে। উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ক্ষেত্রে স্থবিরতা, সামর্থ্য, সক্ষমতা বা সদিচ্ছার অভাব, ভীতি-উৎকণ্ঠা, সব মিলিয়ে দুদকের দৃঢ়তার ঘাটতি দেখা গেছে,” বলেন তিনি।

টিআইবির নির্বাহী মনে করেন, “কত দূর পর্যন্ত যেতে পারব, কোথায় হাত দিলে তা পুড়ে যেতে পারে; অধিকাংশ সময়ই এই ধরনের একটা সংস্কৃতি বিরাজ করে দুদকে।”

তবে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেপ্তারের ঘটনা উল্লেখ করে ব্যারিস্টার ফরহাদ বেনারকে বলেন, “তিনি ঢাকা মহানগরে যুবলীগের রাজনীতির সবচেয়ে ক্ষমতাধর মানুষ ছিলেন। তাঁর ব্যাপারেও আমরা যেমন কোনো নমনীয়তা দেখাইনি।”

“আমাদের দলের হোক বা বাইরের; যে কোনা পর্যায়ের ক্ষমতাবান ব্যবসায়ী হোক বা আমলা; কারও দুর্নীতি বা অনিয়মের ক্ষেত্রেই নরম হবে না এই সরকার,” বলেন তিনি।

ইফতেখারুজ্জামান জানান, সরকারের একাংশের মধ্যেই এই প্রবণতাটা রয়েছে যে দুদক সরকারি প্রতিষ্ঠান, এটা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আবার দুদকের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ আছে।

অগ্রগতির বাধা দুর্নীতি

বর্তমান সরকারের আমলে দেশের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করলেও টিআইবি দাবি করেছে, দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার দুই অঙ্কে পৌঁছে যেত।

তবে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, “প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই তা ব্যবহার হচ্ছে কোথায়? কার ভোগে লাগছে।”

“সেটা স্বচ্ছ ও সৎভাবে বণ্টন করা হচ্ছে কিনা; বা যে খাতে যেই পরিমাণ অর্থটা দেওয়ার কথা বলা হয়, সেটা সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটাও বিবেচনার বিষয়,” বলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা।

যেসব দেশে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হয় না, জালিয়াতি হয়, সেই দেশগুলোতে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেশি উল্লেখ করে টিআইবি আরও বলেছে, বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় শুদ্ধাচারের ঘাটতি রয়েছে।

“বিশেষ রাজনৈতিক বা নির্বাচনের অর্থায়নের স্বচ্ছতার ঘাটতি, তথ্য প্রকাশের ঘাটতি, বা প্রকাশিত তথ্যের যথার্থতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ থাকে। যে কারণে জবাবদিহির ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা তৈরি হয়,” বলেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

সিপিআই ২০১৯ অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এশিয়ায় চতুর্থ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় উল্লেখ করে টিআইবি বলেছে, বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনো উদ্বেগজনক। এর গভীরতার কারণে বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত বা এখানকার সবাই দুর্নীতি করে, এ ধরনের ভুল ব্যাখ্যাও প্রদান করা হয়।

বাংলাদেশের সাথে একই স্কোর পেয়ে বিশ্ব তালিকায় সর্বনিম্ন থেকে ১৪তম অবস্থানে আছে অ্যাঙ্গোলা, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, ইরান, মোজাম্বিক ও নাইজেরিয়া।

৮৭ স্কোর পেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক ও নিউজিল্যান্ড। আর নয় পেয়ে গতবারের মতো এবারও তালিকার সর্বনিম্নে অবস্থান করছে সোমালিয়া, গত ১৪ বছর একই অবস্থানে আছে দেশটি।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।