টিআইবির গবেষণায় সেবাখাতে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র
2016.06.29
পাসপোর্ট, আইনশৃঙ্খলা ও বিচারিক সেবাসহ ১৫টি প্রধান সেবাখাত মিলিয়ে বিভিন্ন সেবা পেতে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে, যা জাতীয় বাজেটের ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। আর দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত হলো পাসপোর্ট। এ খাতে ৭৭ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়।
দুর্নীতির এই ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা জরিপে। ২০১৫ সালের তথ্য নিয়ে করা জরিপের ফল গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। ১৯৯৭ সাল থেকে টিআইবি এ পর্যন্ত ৭টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে। সর্বশেষ খানা জরিপ হয় ২০১২ সালে।
সংস্থাটি বলছে, দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাতের মধ্যে পাসপোর্টের পরেই আছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। এ খাতে সেবা পেতে ৭৪ দশমিক ৬ শতাংশ দুর্নীতি হয়। তৃতীয় অবস্থানে আছে শিক্ষা (সরকারি ও এমপিওভুক্ত) খাত। এ খাতে ৬০ দশমিক ৮ শতাংশ দুর্নীতি হয়।
এ ছাড়া বেশি দুর্নীতি হয় বিআরটিএ (৬০ দশমিক ১ শতাংশ), ভূমি প্রশাসন (৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ), বিচারিক সেবায় (৪৮ দশমিক ২ শতাংশ) ও স্বাস্থ্য (৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ) খাতে৷
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘ঘুষ প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।’ দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ জানান।
টিআইবির গবেষণায় পাসপোর্ট সেবাকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত বলা হলেও স্বরাষ্ট্রসচিব মোজাম্মেল হক খান তা মানতে রাজি নন।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রসচিব বেনারকে বলেন “নাগরিকদের পাসপোর্ট সেবা দেওয়ার জন্য নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এমআরপি পাসপোর্ট দেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছরের পরিবর্তে ১০ বছরের জন্য পাসপোর্ট বই দেওয়া হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের দ্রুততার সঙ্গে পাসপোর্ট পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে এই খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে।” ।
ঘুষ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না
‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ-২০১৫’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের ৬৭ দশমিক ৮ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে, যা খানা প্রতি বাৎসরিক গড় পরিমাণ ৪ হাজার ৫৩৮ টাকা।
২০১৫ সালে সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানির হার ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত (৬৭.৮ শতাংশ বনাম ৬৭.৩ শতাংশ) থাকলেও সেবাগ্রহণকারী খানাগুলোকে ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেশি দিতে হয়েছে।
সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের জনগণের ওপর ঘুষ তথা দুর্নীতির বোঝা বেশি। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৭১ শতাংশ খানা ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে বলেন, ঘুষ না দিলে কাঙিক্ষত সেবা পাওয়া যায় না।
টিআইবি বলছে, জাতীয়ভাবে মোট ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই অর্থের পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ।
টিআইবি জানায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কমিউনিটি সিরিজের আলোকে নমুনা কাঠামো তৈরি করে জরিপটি পরিচালিত হয়। গ্রামাঞ্চলে ৭০ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে ৩০ শতাংশ নমুনা বিবেচনায় নেওয়া হয়। জরিপের আওতাভুক্ত ১৫ হাজার ৮৪০টি খানার মধ্যে ১৫ হাজার ২০৬টি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
১৫টি প্রধান সেবা খাত হলো; স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি প্রশাসন, কৃষি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, কর ও শুল্ক, এনজিও, পাসপোর্ট, গ্যাস, বিআরটিএ ও বিমা।
এ ছাড়া তথ্য প্রদানকারীরা অতিরিক্ত যেসব খাত ও উপ-খাতের তথ্য দিয়েছে সেগুলো ‘অন্যান্য’ (ওয়াসা, বিটিসিএল, ডাক ইত্যাদি) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ঘুষের হার বেড়েছে
জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৫ সালে সেবা খাতে ঘুষের শিকার হওয়ার হার ২০১২ সালের তুলনায় সার্বিকভাবে বেড়েছে। ২০১২ সালে যেখানে ছিল ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ, সেটা বেড়ে হয়েছে ৫৮ শতাংশ ১ শতাংশ।
তবে সার্বিকভাবে অনিয়ম দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, ব্যাংকিং, এনজিও ও অন্যান্য খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার ও বিদ্যুৎ খাতে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। শিক্ষা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর ও শুল্ক খাতে দুর্নীতির হার প্রায় অপরিবর্তিত আছে।
তবে স্বাস্থ্য, বিচারিক সেবা, ভূমি প্রশাসন সহ মোট ৬টি খাতে ঘুষের শিকার খানার হার ২০১২ সালের তুলনায় কমেছে। তবে শিক্ষা, বিদ্যুৎ এবং এনজিও এর ক্ষেত্রে এই হার বেড়েছে।
ঘুষের হার অপরিবর্তিত রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, কৃষি, কর ও শুল্ক ও অন্যান্য খাত। শহরাঞ্চলের তুলনা গ্রামাঞ্চলে সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকোপ বেশি। শহরে ৬২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং গ্রামে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ।
টিআইবির সুপারিশ
দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনাসহ প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে জড়িতদের বিভাগীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে ব্যবস্থা, সেবাখাতে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়নের ভিত্তিতে পুরস্কার ও তিরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা করা ইত্যাদি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ঘুষ ছাড়া সেবা প্রাপ্তি এখন প্রায় দুরূহ। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন অসম্ভব।”