জঙ্গিবাদের মূলহোতা তামিম চৌধুরী ও জিয়াউলকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.08.02
160802-BD-masterminds-620.jpg কল্যাণপুরের তাজ মঞ্জিল ঘিরে রেখেছে পুলিশ, যেখানে গত ২৫ জুলাই দিবাগত রাতে পুলিশের এক বিশেষ অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়। জুলাই ২৬, ২০১৬।
এএফপি

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী ও সেনাবাহিনী থেকে পদচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি জঙ্গি হামলার মূলহোতা বলে পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ সদরদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্য প্রকাশ করেন। এ দুজনকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা করে পুরস্কারও ঘোষণা করেন তিনি।

গণমাধ্যমে বেশ কিছুদিন ধরে জঙ্গি হামলায় তামিম চৌধুরী ও সৈয়দ জিয়াউল হকের নাম আসছিল। তবে গতকালই প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুজনের নাম ঘোষণা করা হয়।

পুলিশ বলছে, গুলশানের হলি আর্টিজান, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ার হামলায় তামিম চৌধুরী পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। গুলশানের হামলাকারীদের সঙ্গে তামিম তাদের বসুন্ধরার বাসায় গিয়েছিলেন। যোগাযোগ ছিল কল্যাণপুরের জঙ্গিদের সঙ্গেও। নিশ্চিত তথ্যের ভিত্তিতেই কল্যাণপুরের ঘটনায় মিরপুর মডেল থানায় তামিম চৌধুরীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করার কথা জানিয়েছে পুলিশ।

ওই সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক ছাড়াও র‍্যাবের মহাপরিচালক বেনজির আহমেদ, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, পুলিশের বিশেষ শাখা ও অপরাধ তদন্ত বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে শহীদুল হক বলেন, “তদন্ত করতে গিয়ে আমরা যা পেয়েছি, এখানে মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী। নিউ জেএমবির নেতৃত্ব সে দিচ্ছে। এই তামিম চৌধুরীর পর যারা দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রধান তাদেরও আমরা চিহ্নিত করেছি। তাদের আমরা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।”

“আরেকটা গ্রুপ আছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। সেখানে তদন্তে আমাদের ধারণা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে চাকরিচ্যুত মেজর জিয়া,” জানান পুলিশ প্রধান।

কে এই তামিম চৌধুরী?

তামিম চৌধুরী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক। গত ১৩ এপ্রিল অনলাইনে প্রকাশিত আইএসের নিজস্ব সাময়িকী ‘দাবিক’-এর ১৪ তম সংখ্যায় আইএসের কথিত বাংলাদেশ-প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল-হানিফের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হয়। পরে জানা যায়, এই ব্যক্তি হলেন তামিম, যিনি কানাডার উইন্ডসোরের বাসিন্দা।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী। ফটোঃ পুলিশ সদর দপ্তর।

তামিমের বাবার নাম শফিক আহমেদ চৌধুরী। মায়ের নাম খালেদা শফি চৌধুরী। বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার বড়গ্রাম ফাদিমাপুরে। তামিমের জন্মের আগেই শফিক আহমেদ চৌধুরী সপরিবারে কানাডা চলে যান। সেখানেই ১৯৮৬ সালে তামিমের জন্ম হয়।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ তামিম সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেছে। ওই বিভাগের প্রধান মনিরুল ইসলাম বেনারকে বলেন, “২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর তামিম দুবাই থেকে ইত্তেহাদের একটি ফ্লাইটে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। তিনি দেশ ছেড়েছেন এমন কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই।”

কবে থেকে তামিমের জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানতে পেরেছে এমন প্রশ্নে মনিরুল ইসলাম বলেন, “গত বছর থেকে আমরা তামিমের সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হই।”

সৈয়দ জিয়াউল হক ফের আলোচনায়

ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর পলাতক আসামি সৈয়দ জিয়াউল হকই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সামরিক শাখার প্রধান। তার নাম প্রথম প্রকাশ হয় ২০১২ সালে। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তিনি। তখন থেকেই তিনি পলাতক। ২০১২ সালের ১৮ মার্চ তাকে ধরতে জারি হওয়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পুলিশ ও র‍্যাব সদর দপ্তরে পাঠানো হয়।

সৈয়দ জিয়াউল হক দেখতে যেমন হতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। ফটোঃ পুলিশ সদর দপ্তর।

পুলিশ মহাপরিদর্শক শহীদুল হক বলেন, “তদন্তে দেখা গেছে দেশে ব্লগার খুনের ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। এই টিমের সামরিক শাখার প্রধান সৈয়দ জিয়াউল হক।”

উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে গঠিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম আল কায়েদার মতাদর্শে বিশ্বাসী। শুরুতে তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ ছিল পাঠচক্র ও ইন্টারনেটে প্রচারের মাধ্যমে। ২০১৩ সালে আহমেদ রাজিব হায়দারকে খুনের মাধ্যমে দলটি তাদের আসল রূপ প্রকাশ করে।

মনিরুল ইসলাম বলেন, “জিজ্ঞাসাবাদে ওই দলের সদস্যরা সৈয়দ জিয়াউল হকের পরিচয় নিশ্চিত করেছে। তার ভূমিকার উল্লেখ করে গ্রেপ্তার হওয়া সদস্যরা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে।”

সৈয়দ জিয়াউল হক সামরিক শাখার দায়িত্ব নেওয়ার পর গতবছর সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই দলটির আধ্যাত্মিক গুরু জসিমুদ্দীন রাহমানী ৪০ জন সহযোগীসহ ২০১৩ সালে গ্রেপ্তার হন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, একাধিকবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিনি সৈয়দ জিয়াউল হকের সঙ্গে দেখা করেছেন।

সৈয়দ জিয়াউল হকের স্থায়ী ঠিকানা মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুর। তার বাবার নাম সৈয়দ মো. জিল্লুল হক। সবশেষ তিনি ঢাকা সেনানিবাসের ‘পলাশ’ ভবনের ১২ তলায় থাকতেন।

পুলিশের নলেজেআছেন হাসনাত করিম

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবুল হাসনাত রেজা করিম গ্রেপ্তার আছেন কি না, সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইজিপি শহীদুল হক বলেন, হাসনাত রেজা করিম পুলিশের ‘নলেজে’ আছেন। প্রয়োজন পড়লে যেকোনো সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, হাসনাত করিম সন্দেহের বাইরে নন।

হাসনাত করিমের পরিবার গত মাসের মাঝামাঝিতে জানায়, জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর গত ২ জুলাই রাতে তাঁর সঙ্গে তাদের দেখা হয়। এরপর আর দেখা হয়নি। ওই সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, হাসনাত তাদের হেফাজতে নেই।

বিপথগামীদের ফিরে আসার অনুরোধ

পুলিশের মহাপরিদর্শক সংবাদ সম্মেলনে যেসব তরুণ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছেন তাদের ফিরে আসার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, কোনো রকম অপরাধ না করলে তাদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেবে পুলিশ ও প্রশাসন।

আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান এ প্রসঙ্গে বেনারকে বলেন, “পুনর্বাসনের পরিকল্পনা অবশ্যই সাধুবাদ পেতে পারে। তবে যে কারণে তরুণেরা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েছে তা খতিয়ে দেখা দরকার। সেই কারণগুলো দূর করতে পারলে পুনর্বাসনের চেষ্টা সফল হবে।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।