ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে প্রতিদিন জরিমানা আদায়ের নির্দেশ স্থগিত

ঢাকা থেকে শাহরিয়ার শরীফ
2016.06.28
Tanary-Dhaka620.jpg রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকায় চামড়ার বর্জ্যে এভাবেই পরিবেশ দুষণ হচ্ছে, ভরাট হচ্ছে পুকুর ও ডোবা। জুন ২৪, ২০১৬।
স্টার মেইল

রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে চামড়া শিল্প-কারখানা সরিয়ে না নেওয়ায় ১৫৪টি ট্যানারি মালিকের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার বিচারপতি এ সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন।

চেম্বার বিচারপতি হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর না করা পর্যন্ত প্রত্যেক মালিকের কাছ থেকে জরিমানা আদায় আগামী ১৭ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত করেছেন।

এর আগে গত ১৬ জুন বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি এ কে এম সাহিদুল হকের যৌথ হাইকোর্ট বেঞ্চ জরিমানা আদায়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, যত দিন কারখানা না সরানো হবে তত দিন এই জরিমানা সরকারি কোষাগারে জমা হতে থাকবে।

পরিবেশ বিনষ্ট হওয়ায় গত প্রায় তিন বছর আগে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সারানোর নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। পরে আদালত নির্দেশ অমান্যকারী প্রতিষ্ঠানের তালিকা চান শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাছে।

আদালতের নির্দেশে ১৫৫টি ট্যানারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তালিকা জমা দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি সাভারে গেছে। বাকি ১৫৪টি প্রতিষ্ঠান এখন পর্যন্ত হাজারীবাগেই আছে।

এসব কারখানা স্থানান্তর না হওয়ায় আদালত অবমাননা করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন পরিবেশবাদী ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) আইনজীবী মঞ্জিল মোরশেদ। তিনি প্রত্যেককে জরিমানা করার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন।

মঞ্জিল বলেন, চামড়া শিল্প মালিকেরা তাঁদের কারখানা রাজধানী থেকে সরাতে আজ হোক আর কাল হোক বাধ্য হবেন। সরকারের দেওয়া সুযোগ–সুবিধা নিয়ে তাঁরা আগেভাগে চলে গেলে শোভনীয় হতো।

দেশীয় কাঁচামালনির্ভর রপ্তানিমুখী এ শিল্প প্রথম ১৯৪০ সালে স্থাপন করা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জে। ১৯৫১ সালে এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকার ভূমি অধিগ্রহণ করে এ শিল্প নারায়ণগঞ্জ থেকে হাজারীবাগে স্থানান্তর করে। হাজারীবাগ থেকে কারাখানাগুলো এখনো সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তর না করায় বুড়িগঙ্গার পানি দূষণ বেড়েই চলেছে।

“সাভারে কারাখানা সরানোর জন্য আমরা সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি। কারাখানা মালিকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে সরকার। এরপরও কেউ না গেলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে,” বেনারকে জানান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু।

তিনি বলেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সরাতে উচ্চ আদালতের নির্দেশ কার্যকর করতে সরকার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া পরিবেশ দূষণের ব্যাপারে সরকার কোনো ধরনের ছাড় দেবে না।

পরিবেশবাদী আইনজীবীদের সংগঠন বেলার দাখিল করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০১ সালে ট্যানারি শিল্প হাজারীবাগ থেকে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সরকারপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরে ওই সময়সীমা কয়েক দফা বাড়িয়ে ২০১৩ সাল পর্যন্ত করা হয়।

কিন্তু এর পরও ওই নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হওয়ায় ২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল আদালত অবমাননার রুল জারি করেন হাইকোর্ট। একপর্যায়ে আদালত শিল্পসচিব ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিককে তলব করেন।

এ সময় আইনজীবী মঞ্জিল মোরশেদ আদালতে বলেন, ২০১৩ সালের মধ্যে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরানোর নির্দেশনা ছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এ নির্দেশ আমলে নেননি। উচ্চ আদালতের প্রতি তাঁরা অবজ্ঞা দেখিয়েছেন।

তাই প্রত্যেক মালিককে প্রতিদিন জরিমানা হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে এক লাখ টাকা করে জমা দেওয়ার নির্দেশনা চান তিনি। এরপর শুনানি শেষে আদালত ৫০ হাজার টাকা করে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

২০১৩ সালে প্লটের নকশা অনুমোদের পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বিসিক থেকে ট্যানারি শিল্প মালিকদের ২৮ বার তাগাদা দেওয়া হয়েছে কারখানা সরাতে। লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে একাধিকবার।

ট্যানারি না সরালে কারখানার গ্যাস, বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়া এবং ব্যবসার লাইসেন্স বাতিলের হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া শুরু করেছে সরকার। সহজে ব্যাংকঋণের ব্যবস্থা থাকছে। কিন্তু বহু বছরের পুরনো এসব কারখানা সরাতে মালিকরা এগিয়ে আসেননি।

২০০৫ সালে ২০০ একর জায়গাজুড়ে সাভারে চামড়া শিল্পনগরীর কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও প্রস্তুতির মধ্যেই কেটে গেছে এক যুগের বেশি সময়। কয়েক দফা ব্যয় বাড়িয়ে সর্বশেষ হিসাবে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

শিল্পনগরীতে হাজারীবাগের ট্যানারির মালিকদের জন্য ১৫৫টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এসব ট্যানারির বর্জ্য শোধনের জন্য ১৬ একর জায়গাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সিইটিপি। কিন্তু ট্যানারি স্থানান্তর না হলে সিইটিপি চালু করা সম্ভব নয়। সরকার পুরো প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও ট্যানারি মালিকরা এখন গড়িমসি করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চামড়া ব্যবসায়ি বেনারকে বলেন, “এটা বিচারাধীন বিষয়। এ জন্য মন্তব্য করবেন না। তবে এটুকু বলতে চান, যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি শিল্প সরিয়ে নেওয়াটা অতো সহজ নয়।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।