ছয় মাসেও তনু হত্যার বিচারে অগ্রগতি নেই, চলছে বিক্ষোভ–সমাবেশ

ঢাকা থেকে জেসমিন পাপড়ি
2016.09.21
20160921-Tonu-Follow-up620.jpg কুমিল্লায় তনুর ঘাতকদের গ্রেপ্তারের দাবিতে প্রতিবাদী সংগীত-সমাবেশ আয়োজন করে অচিন পাখি বাউল গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন। সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৬।
নিউজরুম ফটো।

কুমিল্লার কলেজছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যার ছয় মাস পার হলেও অপরাধী আটক বা শনাক্ত করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি। তনুর পোশাক থেকে সংগ্রহ করা ধর্ষণের আলামতসহ তিন ব্যক্তির ডিএনএ নমুনা চার মাসেও সন্দেহভাজন কারও সঙ্গে মেলাতেও পারেননি তারা।

মানবাধিকার কর্মীদের মতে, স্পর্শকাতর এ ঘটনার বিচার শুরু করতে না পারাটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এমন বিচারহীনতা সমাজে সব ধরনের অপরাধকে উসকে দেয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে তদন্ত চলছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। গত ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনুর লাশ পাওয়া যায়।

এদিকে ছয় মাস পূর্ণ হওয়া বর্বরোচিত এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে তনুর পরিবারসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক সংগঠন। তনুর আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া মাহফিলেরও আয়োজন করা হচ্ছে। গতকাল বুধবার কুমিল্লায় অচিন পাখি বাউল গোষ্ঠী ও গণজাগরণ মঞ্চ নামে দুটি সংগঠন বিক্ষোভ–সমাবেশ আয়োজন করে, যেখানে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ অংশ নেন।

তদন্ত গতিহীন, মেলানো হয়নি ডিএনএ প্রোফাইল

হত্যার পর দুই দফা তনুর লাশের ময়না তদন্ত করা হয়। যদিও ময়না তদন্তের রিপোর্ট বিভ্রান্তিমূলক। প্রথম দফা ময়না তদন্তে তনুকে ধর্ষণের আলামত পাওয়া না গেলেও তনুর ডিএনএ রিপোর্টে তাঁর দেহে তিনজন ব্যক্তির বীর্য পাওয়া যায়।

এই ধর্ষকদের খুঁজে বের করতে সন্দেহভাজনদের সঙ্গে নমুনা মিলিয়ে দেখার কথা জানায় সিআইডি। সে ঘটনার চার মাস কেটে গেলেও এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পুরো তদন্ত প্রক্রিয়াকে গতিহীন করতে পরিকল্পিতভাবে এসব করা হচ্ছে।এ ছাড়া বারবার তদন্ত কর্মকর্তা বদল করে মামলার তদন্তকে প্রায় থামিয়ে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেছে তনুর পরিবার।

জানা যায়, তনু হত্যা মামলাটি গত ১ এপ্রিল সিআইডিতে স্থানান্তর করা হয়। সে সময় মামলাটি পরিচালনার দায়িত্ব পান সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. নাজমুল করিম খান এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন সিআইডির পরিদর্শক গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম। তিন মাসের মধ্যেই নাজমুল করিম খানকে কুমিল্লা থেকে বদলি করে রাজশাহীতে পাঠানো হয়।

এর পরের মাসেই অসুস্থতার কথা বলে মামলাটির দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান গাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম। গত মাসে সিআইডির এএসপি জালাল উদ্দীন আহমেদ নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে মামলাটির দায়িত্ব পান।

তবে এখন মামলাটির তদন্ত সাধারণ গতিতেও চলছে না বলে বেনারের কাছে অভিযোগ করেন তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন। তিনি জানান, যেসব কর্মকর্তার কাছে নিজেদের সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন, তারা না থাকায় তদন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ইয়ার হোসেন বেনারকে বলেন, “নতুন সিআইডি কর্মকর্তার কাছে মামলা হস্তান্তরের কথা আমাদেরকে জানানোই হয়নি। তিনি (জালাল উদ্দীন আহমেদ) একবারই আমাদের কাছে এসে জানিয়েছিলেন, তিনি মামলার তদন্ত করছেন। আর কোন যোগাযোগ তিনি করেননি।”

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, “আমার মেয়েটাকে খুন করা হলো। অথচ বিচার চাইতে গিয়ে আমার কণ্ঠ চেপে ধরা হয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎকার দিতে নিষেধ করা হয়। এখন বিচার পাওয়ার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। তবে আল্লাহ বিচার করবে।”

তিনি বলেন, “আমরা শুরু থেকেই কয়েকজন সেনা সদস্যকে সন্দেহ করেছিলাম। তাদের নামও বলেছিলাম। কিন্তু ওরা সেনাবাহিনীর লোক হওয়ায় বিচার হচ্ছে না। সন্তান হারিয়ে আমি কী নিয়ে থাকব সেটা কেউ ভেবে দেখে না।”

তনুর বাবা বলেন, “এ দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমরা খুব হতাশ হয়ে পড়ছি।”

তবে ইয়ার হোসেনের অভিযোগকে অস্বীকার করে মামলার বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) জালাল উদ্দীন আহমেদ বুধবার বেনারকে বলেন, “এই মুহূর্তে বলার মত কিছু নেই। শুধু বলতে পারি ধারাবাহিক তদন্ত চলছে। অগ্রগতি তো থাকবেই।”

এখন পর্যন্ত কাউকে শনাক্ত করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তদন্তের স্বার্থে এটা এখন বলা যাবে না।”

গত ২০ মার্চ রাতে টিউশনি করিয়ে ফেরার পথে খুন হন কলেজশিক্ষার্থী ও নাট্যকর্মী তনু। কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের ভেতরে একটি ঝোপের মধ্যে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। পরদিন দুপুরে তনুর লাশের প্রথম ময়নাতদন্তের পর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা মির্জানগরে তাঁকে দাফন করা হয়।

প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবারের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করা হয়, যা নিয়ে ব্যাপক তোলপাড়ের পর বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এরপর গত ২৮ মার্চ কবর থেকে লাশ তুলে দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত হয়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর পাওয়া সে প্রতিবেদনেও মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা যায়নি। তবে মৃত্যুর আগে তনুর ‘এভিডেন্স অব সেক্সুয়াল ইন্টার কোর্স’ হওয়ার প্রমাণ পাওয়ার কথা সাংবাদিকদের জানায় ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক ডা. কামদা প্রসাদ সাহা। সে প্রতিবেদনও প্রত্যাখ্যান করে তনুর পরিবার।

তবে সিআইডির পাওয়া ডিএনএ নমুনার মাধ্যমে আসামি শনাক্ত করার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।

তনু হত্যাকারীদের আটক ও বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ, সমাবেশ ও মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে সারা দেশের ছাত্র, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক সংগঠন। আজ পর্যন্ত এ বিষয়ের সুরাহা না হওয়ায় তনুর পরিবারের পাশাপাশি পুরো দেশ হতাশ হয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বেনারকে বলেন, “তনুর খুনি শনাক্ত না হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ঘটনাটি ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ছয় মাসেও এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামিদের খুঁজে বের করতে না পারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম ব্যর্থতা।”

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।