বিজ্ঞাপন আর রাজনীতির খেলায় বিপর্যস্ত পুজোর কলকাতা

কলকাতা থেকে মাসুমা পরভীন
2015.10.19
WB-puja কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কে পুঁজোর আসরে নির্মাণ করা হয় বৃহত্তম দূর্গা-প্রতিমা, দুর্ঘটনা এড়াতে পুলিশ তা বন্ধ করে দেয়। ১৮ অক্টোবর, ২০১৫
অনলাইন

দুর্গাপূজার চার দিন মা দুর্গা যুদ্ধ করেন অসুরের সঙ্গে। কিন্তু এ বছর কলকাতায় যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল পুজোর প্রায় চার মাস আগেই।

না, দেবী-অসুরের যুদ্ধ নয়। বিজ্ঞাপনের যুদ্ধ।

জুলাইয়ের গোড়া থেকেই শুধু কলকাতা নয়, শুধু পশ্চিমবঙ্গও নয়, গোটা পূর্ব ভারতে ছেয়ে গিয়েছিল একটা বিজ্ঞাপন— বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা এ বার কলকাতায়। কোনও বিজ্ঞাপনের ছবিতে দেখা যাচ্ছে প্রতিমার এক বিরাট  পা, কোনওটায় প্রতিমার চোখ। সবই অস্বাভাবিক বড় মাপের। স্বভাবতই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল বিজ্ঞাপনটি। প্রতিযোগী পুজোগুলির দৃষ্টিও। তার পরেই হরেক পুজোর বিজ্ঞাপনে ঢাকা পড়ল কলকাতা।

কোনওটায় লেখা, ‘মায়ের আবার ছোট বড়, মা কি কারও একার?’ কোনওটার দাবি, ‘নাক-কান নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই’। কোনও বিজ্ঞাপন আবার প্রশ্ন তুলল, যে পুজোর কেন্দ্রে থাকা উচিত ভক্তি, তাকে কি প্রতিমার মাপ দিয়ে দেখা উচিত? আবার, কোনও বিজ্ঞাপন বলল, তাদের পুজো বড় ভক্তিতে, অন্তরের শ্রদ্ধায়। বলে দেওয়ার বোধ হয় দরকার নেই, সব বিজ্ঞাপনই প্রতিযোগী পুজোগুলির। এমন বিজ্ঞাপনী লড়াই পুজোর কলকাতা আগে কখনও দেখেনি। আগে কখনও এমন যুদ্ধ বাঁধেনি শহরের পুজোগুলির মধ্যে।

পুজোর মাস দেড়েক আগে জানা গেল, সবচেয়ে বড় দুর্গা আসলে দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম পুরনো সর্বজনীন পুজো দেশপ্রিয় পার্কের। তারা জানাল, চতুর্থীর দিন তাদের পুজোর উদ্বোধন। রেডিও, টেলিভিশনেও তাদের বিজ্ঞাপনের বান ডাকল। কলকাতার পুজোর ইতিহাসে এই প্রথম এত বড় প্রতিমা তৈরি হল।

প্রতিমার উচ্চতা ৮৮ ফুট। স্বভাবতই, উদ্বোধনের দিন, শনিবার, ঢল নামল জনতার। আরও বেশি ভিড় জমল রবিবার, পঞ্চমীর দিন। এত ভিড় যে তার চাপে অচল হয়ে গেল গোটা দক্ষিণ কলকাতা। এবং, এত ভিড় যে তার চাপে পদপৃষ্ট হয়ে দর্শনার্থীদের মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হল। বস্তুত, আহত হলেন বেশ কয়েক জন। তাঁদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে সঙ্কটে পড়লেন নিকটজনরা— রাস্তা যে বন্ধ হয়ে আছে।


পুলিশ পুজো বন্ধ করে দিলো যে কারণে

কলকাতা পুলি‌শের সদর দফতর লালবাজার থেকে দেশপ্রিয় পার্কে পৌঁছল বিরাট পুলিশবাহিনী। এলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, যৌথ কমিশনার সুপ্রতিম সরকার। কিন্তু, বিচিত্র কাণ্ড— নিজেদের গাড়িতে আসতে পারলেন না তাঁরাও। মধ্য কলকাতায় শহরের প্রাণকেন্দ্র এসপ্লানাডে গাড়ি রেখে তাঁরা বাকি পথ মেট্রো রেলে যেতে বাধ্য হলেন। ভিড়ের চাপে তখন মেট্রোরও নাভিশ্বাস উঠছে। দেশপ্রিয় পার্কের নিকটবর্তী স্টেশন কালীঘাটে বড় দুর্ঘটনা এড়াতে মেট্রো কর্তৃপক্ষ বাধ্য হচ্ছেন মাঝেমধ্যেই ট্রেন চলাচল থামিয়ে দিতে। একটা পুজো গোটা শহরকে কার্যত দমবন্ধ করে ফেলেছে তখন।

দেশপ্রিয় পার্কের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে পুলিশ কমিশনার সিদ্ধান্ত করলেন, বন্ধ করে দেওয়া হবে পুজো। গত পঞ্চাশ বছরে শহরের কোনও বারোয়ারি পুজো এ ভাবে বন্ধ করে দেওয়ার আর কোনও নজির নেই। দূরদূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা স্বভাবতই হতাশ। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ট্রেনে সফর করে পূর্ব মেদিনীপুর থেকে দেশপ্রিয় পার্কের ‘সবচেয়ে বড় দুর্গা’ দেখতে এসেছিলেন সুপ্রিয় মাইতি। বললেন, ‘ভেবেছিলাম, পঞ্চমীর দিন ভিড় কম হবে। চার-পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে, এই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর এখন শুনছি পুলিশ পুজো বন্ধ করে দিচ্ছে। কোনও মানে হয় না। পুরো দিনটা নষ্ট হল আমার।’


স্থানীয় বাসিন্দারা অবশ্য হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন

কালীঘাট অঞ্চলের বাসিন্দ ঐন্দ্রিলা মুখোপাধ্যায় ফেসবুকে নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘দেশপ্রিয় পার্কে যা চলছে, সেটা আর যাই হোক, পুজো নয়। এই রকম একটা অবস্থা যে তৈরি হতে পারে, গোটা দক্ষিণ কলকাতা স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে, পুলিশ আঁচ করতে পারেনি?’ পুজো বন্ধ করে দেওয়ার পর তিনি বললেন, ‘এ বার হয়তো যানজট একটু কমবে। পুজোর ক’টা দিন কলকাতা কী রকম নরক হয়ে যায়, এই শহরে না থাকলে বোঝার উপায় নেই।’

রবিবার বিকেলে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন ভবানীপুর অঞ্চলের বাসিন্দা শান্তনু গাঙ্গুলি। প্রায় তিন ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকার পর কোনও ক্রমে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। বললেন, ‘এত বছরে কখনও এই বিশৃঙ্খলা দেখিনি। একদম মানুষ-মারা ভিড়।’

রবিবার রাতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে কলকাতার পুলিশ কমিশনার ইঙ্গিত দিলেন, এ বছর হয়তো দেশপ্রিয় পার্কের পুজো আর খুলতে দেওয়া হবে না। তিনি বললেন, ‘আরও তো অনেক পুজো আছে। দর্শনার্থীরা সেগুলো দেখুন।’ কেন এমন সিদ্ধান্ত, সে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘এই পুজোয় অনুমতির জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত মানা হয়নি। পুজো কমিটির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ পুলিশ কমিশনারের কথা অবশ্য উড়িয়ে দিলেন পুজো কমিটির কর্তা সুদীপ্ত কুমার। বললেন, ‘সবাই যে ভাবে অনুমতি পেয়েছে, আমরাও সে ভাবেই পেয়েছি। অনুমতি না পেলে এত বড় পুজো করা যায় নাকি!’


বাণিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাব

ওয়াকিবহাল মহল অবশ্য পুরো ঘটনার পিছনে রাজনীতির দীর্ঘ ছায়া দেখছেন। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা পুলিশের এক কর্মী বললেন, ‘দেশপ্রিয় পার্ক সর্বজনীনের কর্তা সুদীপ্ত কুমার। তিনি মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমারের ভাই। দেবাশিস আবার রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের অতি ঘনিষ্ঠ হিসাবেই পরিচিত। ফলে, পুলিশ অনেক কিছু খতিয়ে না দেখেই এই পুজোর অনুমতি দিয়েছিল। এখন পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ায় মুখ বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে।’

পুজোপ্রাঙ্গণে উপস্থিত আর এক পুলিশকর্তা আবার বললেন, যে সব পুজোয় এই পরিমাণ ভিড় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেখানে ফুটপাথে ব্যারিকেড তৈরি করে দেওয়া হয়। এই পুজো কমিটি স্পনসরদের মন রাখতে গিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করেনি। তাই এই বিপত্তি।

বাণিজ্য, বিজ্ঞাপন, রাজনীতি, প্রশাসনিক ব্যর্থতা, সব মিলিয়ে কলকাতাবাসীর কাছে এ বছরের দুর্গাপূজার সূচনা হয়ে থাকল রীতিমত ভীতিপ্রদ।

মন্তব্য করুন

নীচের ফর্মে আপনার মন্তব্য যোগ করে টেক্সট লিখুন। একজন মডারেটর মন্তব্য সমূহ এপ্রুভ করে থাকেন এবং সঠিক সংবাদর নীতিমালা অনুসারে এডিট করে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য প্রকাশ হয় না, প্রকাশিত কোনো মতামতের জন্য সঠিক সংবাদ দায়ী নয়। অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন এবং বিষয় বস্তুর প্রতি আবদ্ধ থাকুন।